দিলীপ মজুমদার: আমার চেয়ে বয়সে শুভেন্দু অধিকারী অনেকটা ছোট। তবে তিনি আমার মতো পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার ভূমিপুত্র। নন্দীগ্রামের আন্দোলন থেকে তাঁর উথ্থান। তখন তিনি তৃণমূল নেতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছের মানুষ। স্নেহভাজনও। তৃণমূলের সঙ্গে কোন লেনদেন নেই আমার। তবে শুভেন্দু আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি সুদর্শন, ভদ্র। বিয়ে-থা করেন নি। মঞ্চের বক্তৃতায় খুব একটা লম্ফ-ঝম্ফ করেন না। অ-কথা কু-কথা বলেন না। লড়াকু মানুষ।
বছর খানেক ধরে দেখছি মন্ত্রী থেকেও শুভেন্দুর কেমন গা-ছাড়া ভাব। তাঁর কথায় ক্ষোভের আঁচ। ক্ষোভটা অভিষেক ব্যানার্জী আর টিম পিকের বিরুদ্ধে। মনে হল ক্ষোভটা সঙ্গত। কোন গণ আন্দোলন থেকে আসেন নি অভিষেক। সন্দেহ হয়। ইন্দিরা গাঁধি যেমন রাজীবকে রাতারাতি রাজনীতির মঞ্চে এনে ফেলেছিলেন, তেমনি মমতাও অভিষেককে আনতে চান। উত্তরাধিকার। রাজার ছেলের রাজা হওয়ার মতো ব্যাপার। গতিবিধি দেখে সেরকম মনে হওয়া স্বাভাবিক। তারপর মিঃ পি কে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের মতো ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট। গোড়া থেকে ব্যাপারটা হজম করতে পারিনি। তাহলে কী নিজেদের সংগঠনের উপর ভরসা নেই তৃণমূল সুপ্রিমোর! ভরসা নেই মানুষের উপর!
মাস পাঁচছয় শুভেন্দুকে নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস। ক্ষোভের কথা প্রকাশ্যে বলছেন। দল ও সরকারি কাজে যাচ্ছেন না। ‘দাদার অনুগামী’ গজিয়ে উঠেছে। তাঁরা ফ্লেক্স লাগাচ্ছেন। সভা করছেন। অরাজনৈতিক সভা। দাদা আসছেন, বক্তৃতা করছেন। বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে বলে যাচ্ছেন ক্ষোভের কথা। অস্বাভাবিক মনে হয় নি খুব একটা। সত্যিই তো, মমতা অমর্যাদা করছেন শুভেন্দুর। সৌগত রায় এলেন আলোচনা করতে। মনে হল আবার একটা ভাব-ভাব ব্যাপার হতে যাচ্ছে। এমন এক দিন সাংবাদিক অমর নস্করের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন যে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেবেন। আমি তাঁকে বললাম যে তাঁর ধারণা ভুল। বড়জোর আলাদা দল গড়বেন শুভেন্দু। ধাক্কা দেবেন মমতাকে। আমার প্রাক্তন সহকর্মী অভিজিৎ ব্যানার্জী দিন তিনেক আগে ফোন করে বললেন, এটা কী হল দিলীপদা? শুভেন্দু অধিকারী যোগ দেবেন বিজেপিতে !
আরও পড়ুন:
বছর খানিক মেঘনাদের মতো মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করতে করতে শুভেন্দু গতকাল মেদিনীপুরের সভায় বিজেপির কাছে সমর্পণ করলেন নিজেকে। অমিত শাহ মহাশয়ের পদযুগল স্পর্শ করে নতুন দীক্ষা নিলেন। গুরু মেনে নিলেন অমিত শাহকে। ভক্তিবিনম্র হয়ে জানালেন যে বাচ্চার মতো তিনি গুরুর কাছে রাজনীতির পাঠ নিতে চান। বললেন আগে তিনি বিজেপি হঠাৎ স্লোগান দিয়েছেন, এখন তিনি ভাইপো হঠাও স্লোগান দেবেন। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, ভাইপোকে তাড়ানোর জন্যই তাঁকে যোগ দিতে হচ্ছে বিজেপিতে। দলে থেকে সেটা কী তিনি করতে পারছিলেন না? খোলসা করে বললেন না কেন?
থলে থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল শুভেন্দুর আর একটা কথায়। বিজেপির সঙ্গে তাঁর যোগ ২০১৪ সাল থেকে। তখন তো তাঁর দল তৃণমূলের গমগমে অবস্থা। ২০১৯ থেকে হলে তবু একটা যুক্তি থাকত। ২০১৯ সালে তৃণমূল বেশ ব্যাকফুটে, নানা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সেই সুযোগে লোকসভা ভোটে মার হাব্বা করে বিজেপি কদম কদম বাড়ায়ে যাচ্ছে।
তার মানে দলের রমরমার দিনে, যখন দলে তাঁর গুরুত্ব পাকাপোক্ত, তখন থেকেই তিনি বিজেপির দিকে পা বাড়িয়ে আছেন? তার মানে, তখন তাঁর ‘বিজেপি হঠাও’ ধ্বনি নকল ছিল? তার মানে বহু দিন থেকে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছেন? কিন্তু কিসের জন্য? আদর্শের জন্য নিশ্চয়ই নয়। তিনি যে হিন্দুত্ববাদী, সেকথা তো জানত না মানুষ। তাহলে কিসের জন্য? একটাই তো অপশন থাকে। পদের জন্য, আত্মরক্ষার জন্য, কাঞ্চনরঙ্গের জন্য।
আরও পড়ুন:
মানুষের মনে শুভেন্দুর যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল, তা কী চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে না? হওয়াই তো স্বাভাবিক। কিন্তু হবে না। ভোটার নামক জনগণেশের স্মৃতি বড় ক্ষণস্থায়ী। বড় ক্ষমাশীল তাঁরা। কত দাগী আসামিকে ক্ষমা করে তাঁরা ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন। তাই ফৌজদারি মামলার লকেট গলায় ঝুলিয়ে কত প্রার্থী ভোটে দাঁড়ান নির্ভয়ে। ভোটে জিতে গলায় গাঁদাফুলের মালা পরে জনতার সেবা করার উদাত্ত প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনতার পকেট কাটতে শুরু করে দেন। তাই দল ভাঙানো চলতে থাকে। মহামান্য মুকুল রায় তো বলেই দিয়েছেন যে দল ভাঙানোর খেলাটা রাজনীতির অঙ্গ। সত্য সেলুকস, কী বিচিত্র এই দেশ!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
আরও পড়ুন: