আপনজন ডেস্ক: উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অসমে ভয়াবহ বন্যার পর এখন অনলাইনে প্রচার চলছে যে, স্থানীয় মুসলমানরাই এই বন্যার জন্য দায়ী। অর্থাৎ মুসলিমরাই নাকি এই ম্যানমেড বন্যার জন্য দায়ী। একে অতিরঞ্জন করে কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী রঙ চড়াতে বলা হচ্ছে ‘’বন্যা-জিহাদ’’। এই সাম্প্রদায়িক অভিযোগের শিকার নাজির হোসেন লস্কর। এক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন, জুলাই মাসের প্রথম দিকে ভোরে পুলিশ যখন তার ঘরের দরজায় নক করে তখন তিনি হতভম্ব হয়ে যান। কারণ, বহু বছর ধরে তিনি নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে অসমের বাঁধ সুরক্ষা ও মেরামতির জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু সেদিন সাতসকালে যে পুলিশ কর্মকর্তা নাজির হোসেনকে আটক করতে যান, তিনি সরকারি সম্পত্তির- বিশেষ করে বন্যা থেকে সুরক্ষার জন্য তৈরি করা বাঁধের ক্ষতির জন্যই তাকে অভিযুক্ত করেন।
‘আমি ১৬ বছর ধরে সরকারের অধীনেই বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতির কাজ করছি। আমি কেন তা ধ্বংস করতে যাব,’ হতবাক হয়ে বলছিলেন নাজির হোসেন। ২০ দিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ এখনো মেলেনি। কিন্তু তাকে নিয়ে ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নাজিরের কথায়, আমি হামলার ভয় পাচ্ছিলাম। উল্লেখ্য, আসামে গত মে ও জুন মাসে দু’বার বন্যা হয় এবং মারা যায় কমপক্ষে ১৯২ জন। যদিও প্রতি বছর মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সময় এই রাজ্যে বন্যা হয়, কিন্তু এবার বর্ষা এসেছিল একটু আগেই এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।কিন্তু এগুলো রেকর্ড বাদ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে ভিন্ন ধরনের অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছিল। কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই তারা দাবি করে যে, এবারের বন্যা ম্যানমেড বা মনুষ্যসৃষ্ট এবং মুসলমানদের একটি দল পার্শ্ববর্তী হিন্দু অধ্যুষিত শিলচর শহরকে বন্যায় ভাসানোর জন্য বন্যা সুরক্ষা স্থাপনার ক্ষতি করে বিদ্বেষবশত এই অপকর্ম করেছে। এরপর আরো তিনজন মুসলমানের সাথে নাজির হোসেনের আটকের ঘটনার পর তাদের দায়ী করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা শুরু হয়। এসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পোস্ট হাজার হাজার শেয়ারও হয়। পরে বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমেও তা প্রচার হয়। কিন্তু পরিস্থিতি নাজির হোসেনের জন্য আরো খারাপ হয়ে ওঠে যখন তিনি কারাগারে। তিনি সেখানে বসে টিভিতে তার নাম শুনতে পান, যেখানে তাকে ‘বন্যা-জিহাদে’র দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। নাজির বলছিলেন, আমি ভয় পেয়েছিলাম এবং কয়েকটা রাতে ঘুমাতে পারিনি। অন্য বন্দীরা এটা নিয়ে বলাবলি করছিল। আমার মনে হচ্ছিলো হয়ত এখনি আমার ওপর হামলা হতে পারে।
বন্যা জিহাদের দাবির আড়ালেঃ ১৯৫০-এর দশক থেকেই অসমে বন্যা ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রে আছে বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি। রাজ্যটিতে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার বাঁধ আছে। কিন্তু অনেক জায়গাতেই বাঁধের অবস্থা ভঙ্গুর এবং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অবস্থায়। গত ২৩ মে বরাক নদীর বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল প্লাবিত হয়। বাঁধ ভেঙ্গে যায় মুসলিম অধ্যূষিত বেথুকান্দি এলাকায়। ফলে পার্শ্ববর্তী হিন্দু অধ্যুষিত শিলচরে ব্যাপক বন্যা হয়। শিলচরের পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট রামানদ্বীপ কাউর বলেছেন, বাঁধ কেটে দেওয়া বন্যার একটি কারণ। কিন্তু শহরে পানি ঢোকার জন্য সেটিই একমাত্র জায়গা নয়। অর্থাৎ নাজির হোসেন ও আরো তিনজন আটকের কারণ হলো এটি। পরে পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে আরো একজনকে আটক করে পুলিশ। তবে বাঁধ কাটার সাথে তাদের কারো কোনো যোগসূত্র এখনো প্রমাণ হয়নি। মুম্বাইয়ের জামসেদজি টাটা স্কুল অফ ডিজাস্টার স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক নির্মলা চৌধুরী বলেছেন, অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙ্গেছে মূলত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। এর কিছু মনুষ্যসৃষ্ট হতেও পারে। এটা হতে পারে যে, স্থানীয়রা ইচ্ছাকৃতভাবে বাঁধ কেটে দেন যাতে করে পানি অন্য দিকে সরে যেতে পারে এবং তাদের এলাকায় বন্যা না হয়।’ শিলচর পুলিশও এর সাথে একমত। পুলিশ কর্মকর্তা রামানদ্বীপ কাউর বলেছেন, ‘বন্যা জিহাদ’ বলে কিছু নেই। আগে প্রশাসন নিজেই পানি সরে যাওয়ার জন্য বাঁধ কেটে দিত। এ বছর তা হয়নি। ফলে স্থানীয়রা নিজেরাই সেটি করেছে।’ নির্মলা চৌধুরী বলছেন, বন্যা জিহাদের মতো কিছু দাবি করে সহজেই দায় এড়ানো যায়। কিন্তু এটা ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা। এ জন্য আরো দক্ষ ও দূরদর্শী পদক্ষেপ দরকার। উল্লেখ্য, এর আগে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর জন্যও একইভাবে শুধুমাত্র জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য মুসলিমদের দায়ী করতে বিজেপি ও তাদের আইটি সেল নোংরা ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু শেষমেষ সুপ্রিম কোর্ট তাদের পাঁয়তারা ধরে ফেলে এবং উল্টে কেন্দ্র সরকারকেই ভর্ৎসনা করে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct