তৃণমূলে কম নয় মহিলা নেত্রীর সংখ্যা। কিন্তু দিদি একজনই। সার্বজনীন দিদি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোন দাদা ছিল না এ দলে। সুব্রত আছেন, সৌগত আছেন, পার্থ আছেন, ফিরহাদ আছেন। কিন্তু এঁরা কেউ দাদা হতে পারেন নি। বিগত মাস চারেক হল এ দলে এক দাদার আবির্ভাব ঘটেছে। ইনি শুভেন্দু অধিকারী। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার ভূমিপুত্র। শিশির অধিকারীর পুত্র। গৌরবর্ণ, সুপুরুষ, অকৃতদার, সাহসী, সুসংগঠক, সুবক্তা। গত তিন-চার মাস ধরে তিনি ‘দাদা’ হয়ে উঠেছেন। জেলায় জেলায় পোস্টার পড়ছে ‘আমরা দাদার অনুগামী’। শুভেন্দুর অরাজনৈতিক সভায় ‘দাদার অনুগামী’দের ভিড় বাড়ছে। অথচ শুভেন্দু অধিকারী মন্ত্রিত্ব ছাড়লেও এখনও দলও ছাড়েননি।
খোলসা করে না বললেও শুভেন্দুর টুকরো-টাকরা বক্তব্যের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ক্ষোভের গন্ধ। ক্ষো্ভটা দলনেত্রীর বিরুদ্ধে নয় । টিম পিকে এবং অভিযেক ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে বলে মনে হয়। এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু শুভেন্দুর নয়, আরও অনেকের। ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পাচ্ছে। সেই ক্ষোভ বিজেপির মূলধন হয়ে উঠছে।
সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, দলের সুপ্রিমোর মুখে কুলুপ। কিচ্ছু বলছেন না তিনি। এ যেন চণ্ডীমঙ্গলের সেই কমলে কামিনী অবস্থা। না গিলতে পারছেন, না উগরে ফেলতে পারছেন। অরাজনৈতিক সভায় শুভেন্দু ইঙ্গিতে-ভঙ্গিতে যা যা বলছেন, তা মমতার মতো মেজাজি মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয় । তবু সহ্য করে যাচ্ছেন তিনি। কারণ শুভেন্দু অধিকারীর পায়ের তলায় শক্ত মাটি আছে। তাঁর জন্য বিজেপি হাত বাড়িয়ে বসে আছে। শোভন চ্যাটার্জীর দলবদলে কলকাতায় দলের ক্ষতি হবে, কিন্তু শুভেন্দুর দলবদলে নানা জেলায় তার প্রভাব পড়বে।
আরও পড়ুন:
কিন্তু দিদি কেন শুনছেন না দাদার কথা? সেই টিম পিকে আর অভিষেক। এঁদেরই বা শুভেন্দুর বাড়া ভাতে ছাই দেবার এত আগ্রহ কেন? সেই ক্ষমতার লোভ। দিদির পরে এসে গেছেন দাদা । দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন জেলায় জেলায়। তাহলে তো রাজ্যের মসনদে বসার উত্তরাধিকার লাভ করতে চলেছেন তিনি। বাধা দিতে হবে। বাধা দিলে বাধবে লড়াই। লড়াই বেধেছে। এখনও পরোক্ষে। তাপ বাড়লে প্রত্যক্ষ হবে। মমতা বান্যার্জী সেসব যে বুঝছেন না তা নয়। কিন্তু চুপ করে আছেন কেন তা বোঝা যাচ্ছে না। দৌত্যগিরির কাজে সৌগত রায়কে নিযুক্ত করা হয়েছে। মমতা নিজে কেন সে ভার গ্রহণ করলেন না? এ বড় বিস্ময়। অন্যদিকে শুভেন্দুও কী বুঝছেন না দলে থেকে লড়াই করার ইতিবাচক দিকটা? না কি শুভেন্দু চাইছেন দল তাঁকে বিতাড়িত করুক, তখন অন্য দলে ভিড়ে পড়বার একটা নৈতিক অধিকার পাবেন?
দলবদলের রাজনীতিটা এদেশে বেশ ভালোই চলছে। এক সময়ে তৃণমূল এ খেলা খেলেছিলেন। তারপরে রঙ্গমঞ্চে বিজেপি আবির্ভূত হতে খেলাটা বুমেরাং হয়ে গেল। মুকুল, অর্জুনরা দলবদল করলেন। তারপরে শোভন। এখন আবার অনেকে পা বাড়িয়ে আছেন। যে বিজেপি আদর্শের বড়াই করেন, সেই বিজেপির দরজা এখন হাট করে খোলা। জঙ্গলমহলের নেতার জন্য, কোচবিহারের নেতার জন্য, শুভেন্দুর জন্য। অর্থের জন্য, নিরাপত্তার জন্যই দলবদল। এক লহমায় এক দল থেকে অন্য দলে। যেন ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল।
আচ্ছা, এসব নেতাদের না হয় বিবেকের বালাই নেই, আত্মদংশন নেই, কিন্তু ভোট দেন যে জনতা, তাঁরাই বা দলবদলকারীদের ক্ষমা-ঘেন্না করে দেন কী করে! দলবদলকারী যে দলে আসুন না কেন, তাঁকে বা তাঁদের ভোটাররা কেন বর্জন করতে পারেন না?
আরও পড়ুন:
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
আরও পড়ুন:
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)