পৃথিবী থাকার স্থান নয়, চিরদিন এখানে থাকা যায় না, কেউ থাকেনি। থাকা নয়, বরং চলে যাওয়াই সুনিশ্চিত। অথচ তার পরও আমরা সোনার হরিণ বা মরীচিকার পেছনে আমৃত্যু দৌড়িয়েই চলছি। এখন ২০২২ সাল। আজ থেকে ১০০ বছর পরের কথা একটু কল্পনা করি। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২১২২। আজকে আমরা যারা এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি, সে সময় আমাদের এক জনও হয়তো বেঁচে থাকব না। প্রত্যেকে আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। শতবর্ষ পরের ভাবনা নিয়ে লিখেছেন এ বি এম আবদুল্লাহ। আজ প্রথম কিস্তি।
আজি হতে শতবর্ষ পরে’—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমর কবিতাটি পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে গিয়েছি ভাবনার জগতে। শতবর্ষ পরে আমাকে, আপনাকে বা আমাদেরকে কেউ কি মনে রাখবে? কেন মনে রাখবে? শতবর্ষ আগে যারা ছিলেন, তাদেরকে কি আমরা মনে রেখেছি? জীবনে কেউই অমর নয় সত্য, কিন্তু মানুষের স্মৃতিতে কারো কারো অমরত্বের রহস্য কী? জীবন তো ক্ষণস্থায়ী, পদ্মপাতার জল। কবির যেমন হাহাকার ‘দম ফুরাইলেই ঠুস’ বা ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা, বন্ধ হইবো রং তামাশা’, বাউলের তেমনই উপলব্ধি ‘একদিন মাটির ভেতরে হবে ঘর রে মন আমার, কেন বান্ধো দালানঘর’। এটাই নির্মম সত্য। কিন্তু এই ক্ষুদ্র জীবনের চলার পথে, আমরা কি তা মনে রাখি? কত ভালোবাসা! কত স্বপ্ন! জীবনকে ঘিরে কত আয়োজন! জীবন সাজাতে, জীবন রাঙাতে, মেধা-শ্রম-সময়ের কী অফুরান বিনিয়োগ! অথচ ভেবে দেখি না, পৃথিবী থাকার স্থান নয়, চিরদিন এখানে থাকা যায় না, কেউ থাকেনি। থাকা নয়, বরং চলে যাওয়াই সুনিশ্চিত। অথচ তার পরও আমরা সোনার হরিণ বা মরীচিকার পেছনে আমৃত্যু দৌড়িয়েই চলছি।
এখন ২০২২ সাল। আজ থেকে ১০০ বছর পরের কথা একটু কল্পনা করি। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২১২২। আজকে আমরা যারা এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি, সে সময় আমাদের এক জনও হয়তো বেঁচে থাকব না। প্রত্যেকে আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। যখন ২১২২ সাল, আমাদের প্রায় প্রত্যেকের দেহ তখন মাটির নিচে, অস্তিত্ব তখন রুহের জগতে। ফেলে যাওয়া সুন্দর বাড়িটা, শখের গাড়িটা, জমিজমা, ধনসম্পদ, টাকাপয়সা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তখন ভোগ করবে। একই নিয়মে দিন চলবে, কর্মযজ্ঞ চলবে। ‘তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে।’ পৃথিবীর বুকে আজকের এই বেঁচে থাকা, এত হইচই, এত মায়াকান্না সব এভাবেই চলতে থাকবে। থাকব না শুধু আমি, ‘একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালি নেই।’ আচ্ছা, তখন কি আমার কথা কেউ ভাববে? আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি আমাকে বা আমাদেরকে মনে রাখবে? নাকি যাদের জন্য সব করতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলাম, তাদের হাতে সময় হবে না আমাকে মনে রাখার। তারা হয়তো তখন নতুন স্বপ্নে বিভোর, নতুন উদ্যমে জীবন সাজাচ্ছে, সেই একই চক্রে বাঁধা পড়ছে, অজান্তে। যদি নিজেদের প্রশ্ন করি, আমরাই কি আমাদের ১০০ বছর আগের প্রজন্মকে মনে রেখেছি? আমাদের বাপ ঠাকুরদা বা অন্য পূর্বপুরুষদের কথা কি আমরা জানি? তাদের নামটাই-বা আমরা কতজন বলতে পারব? মাত্র দুই কি তিন পুরুষের ব্যবধানে নামটা পর্যন্ত হারিয়ে যায়, পরিচয় তো পরে। নেহাত যুগশ্রেষ্ঠ পুরুষ বা নারী না হলে, সবাই হারিয়ে যায় কালের অন্তরালে।
এই ভাবনা কষ্টকর বইকি। তাহলে পৃথিবীতে এসে এত কিছু অর্জন করে আমাদের কী লাভ হলো? যে পিতামাতা সন্তানের জন্য জীবনের সব সময়, শ্রম, ধনদৌলত বিনিয়োগ করেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই, চলে যাওয়ার পর তাদের কথা কেউ মনে রাখে না, ভাবে না, স্মরণ করে না, এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে! আসলে এই পৃথিবীতে নিজের বলে কিছুই নেই। শৈশব থেকে যে প্রচণ্ড দৌড়, এর গন্তব্য কোথায়? আমরা স্কুলে ভালো রেজাল্টের জন্য, কর্মে সাফল্য আর পদোন্নতির জন্য , অর্থ-যশ-খ্যাতি-ক্ষমতার জন্য ছুটে চলি। অন্যকে টেনে নামাতে, ছিদ্রান্বেষণে, কালিমা লেপনে ছোটাছুটির অন্ত নাই। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যও কত প্রাণান্তকর চেষ্টা, তাতে কি শেষরক্ষা হয়? এ ছুটে চলার মাঝে ‘বারবার কারো পানে ফিরে চাহিবার নাই যে সময়, নাই নাই’। অথচ ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান’। আর শেষকালে মনে হয় ‘তুমি কার, কে তোমার’, কী রেখে যাই, কী নিয়ে যাই, কার স্মৃতিতে ঠাঁই পাই। দৌড়ই যার একমাত্র কর্ম, গন্তব্যেই তার সমাপ্তি। অনাগত কাল কেন তবে আমাকে মনে রাখবে? চলে যাওয়া অসংখ্য প্রজন্মের পথ বেয়ে আমরা এই জীবন লাভ করেছি, আবার আগামীর দিনে এমনি অসংখ্য প্রজন্মের ভিড়ে আমরা হারিয়ে যাব। এই অনন্ত মিছিলের মধ্যে নিজেকে কীভাবে তুলে ধরা যায়? ভালো কাজ। মানুষের জন্য কাজ করে, মানুষের তরে জীবন উত্সর্গ করে, মানুষের প্রয়োজনে নিজের সময়-সম্পদ-সামর্থ্য ঢেলে দিয়েই মানুষের স্মৃতিতে স্থান করে নেওয়া সম্ভব।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct