জাফিরা হক: ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য উচ্চ যেথা শির’, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখা লাইনটি যেন আজকের দিনে বারে বারে মনে পড়ে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা কৃষকদের আন্দোলনের রূপ দেখে। পাঞ্জাব হরিয়ানা কৃষকদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া কৃষক আন্দোলন সারা ভারতজুড়ে বন্ধের মাধ্যমে আরও ব্যাপক আকার ধারণ করছে। নতুন কৃষি আইন ও তাকে কেন্দ্র করে কৃষকদের এই আন্দোলন আমাদেরকে আরো একবার সেই ইতিহাসের পাতায় ব্রিটিশ আমলের কৃষক বিদ্রোহের কথা মনে করিয়ে দেয়। পাশ্চাত্যের নৈতিক সমালোচনার জবাবে ভারতীয় উচ্চবর্ণের লোকেরা যখন নিজেদের সমাজকে পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কারের কাজে মনোনিবেশ করেন। তখন গ্রামীণ সমাজ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রবঞ্চনার জবাব সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে দিয়েছিল। ঐতিহাসিক ক্যাথলিন গফ-এর ভাষায় যা ছিল ‘হারিয়ে যাওয়া অধিকারের পুনরুদ্ধার মূলক বিদ্রোহ’।
বর্তমানে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলন অনেকটাই যেন সেই অধিকারের পুনরুদ্ধারের লড়াই। এই কথা বলার আগে আমাদের অবশ্যই জানা দরকার এনডিএ সরকার প্রণীত এই নতুন কৃষি সংস্কার আইন-এ কি এমন বলা হয়েছে, কেনই বা কৃষকরা এই আইনের বিরোধিতা করছেন বা কেন আজ তারা রাজপথে নেমেছেন এই নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্রমাগত দাবি করে আসছে এই আইন কৃষকদের ভালোর জন্যই করেছেন তারা। আদতে সত্যি কি কৃষকদের ভালোর জন্য কিছু আছে এই নতুন কৃষি আইনের মধ্যে। প্রথম যে বিলটি পাস হয়েছে তা হল ফার্মার্স প্রডিউস অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট, ২০২০। তাতে বলা হয় ক্রেতা বা ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির সঙ্গে কৃষকরা সরাসরি কেনাবেচা করতে পারবে। এক্ষেত্রে সরকার কোনও রকম দায়িত্ব নেবে না বা এই বিষয়ে কোন রকম হস্তক্ষেপ করবে না। দ্বিতীয় যে বিলটি পাস হয় তা হল ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাস্যুওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট, ২০২০। যেখানে বলা হয়েছে কৃষক আগে থেকেই ক্রেতার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকবে নির্দিষ্ট দামে শস্য পণ্য বিক্রি করার জন্য। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি যে সমস্ত কোম্পানি বা সংস্থা বা ক্রেতাদের সঙ্গে কৃষকরা চুক্তিবদ্ধ থাকবে সে ক্ষেত্রে কিন্তু তাদের যদি কোনরকম আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়, তার দায়ভার কোম্পানিগুলি বা বেসরকারি সংস্থাগুলি নিতে বাধ্য নয়। এখানে স্পষ্ট হয়ে যায় যে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির দায় কেউই নেবে না। অনেকটা সেই ব্রিটিশ যুগের রাজস্ব আইন-এর স্বরূপ, যাতে কৃষককে বাধ্য করা হতো অগ্রিম চুক্তিবদ্ধ থাকতে। তাদের ইচ্ছামতো শোষণও করা যেত। প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো কারণে ফসল নষ্ট হলে তার দাম তারা পেত না। জোর করে কৃষকদের কাছ থেকে ব্রিটিশ সরকার রাজস্ব আদায় করত। এখন সেই সুযোগ বেসরকারি সংস্থা ও কোম্পানিগুলোকে দিয়ে দিয়েছে এই নয়া কৃষি আইন। তারা ইচ্ছামত দাম নির্দিষ্ট করে ইচ্ছামত শোষণ করতে পারবে। স্বভাবতই পাঞ্জাব রাজ্যের মানুষের পক্ষে এই রকম একটি আত্মঘাতী কৃষি আইন কখনোই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তৃতীয় যে বিলটি পাস হয় তা হল এসেনশিয়াল কমোডিটিস (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০২০। এই বিল অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য। যেমন, ডাল, আলু, পিঁয়াজ, চিনি, ভোজ্য তেল সহ আরও বেশ কিছু পণ্য। এই সমস্ত পণ্য মজুদ করে রাখার সর্বোচ্চ সীমাও তুলে দেওয়া হয়েছে এই বিলের মাধ্যমে। এই নতুন বিল অনুযায়ী সরকার কোনভাবেই দায়ী থাকবে না কৃষকদের প্রয়োজনে এই সমস্ত্য পণ্য বা দ্রব্যাদি কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করার জন্য। বেসরকারি সংস্থা কোম্পানি নিজেরাই অনির্দিষ্টকালের ইচ্ছামতো এই সকল দ্রব্যাদি গুদামজাত করতে পারবে। আর সরকার নয় তারাই এক্ষেত্রে বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
এছাড়া যে বিষয়টি নিয়ে কৃষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, তা হল ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে এই বিলে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। কিংবা কোনওপ্রকার ব্যবস্থার নেওয়ার কথাও নেই এই বিলে। এই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ছিল একপ্রকান রক্ষাপ্রাচীর। যেখানে সরকার একটি নির্দিষ্ট করে দিত এবং সে ক্ষেত্রে কৃষকদের লাভ-ক্ষতির বিষয়টিকে সরকার অনেকটাই দায়বদ্ধ থাকত। বাজারমূল্য একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকার ফলে কোনও ক্রেতাই কৃষকদের থেকে জোরপূর্বক ইচ্ছামত দামে ক্রয় করতে পারত না। সরকার দ্বারা নির্দিষ্ট করে দেয়া বাজার মূল্যেই তারা শস্যপণ্য কিনতে তারা বাধ্য ছিল। পুরনো ব্যবস্থা অনুযায়ী অবৈধভাবে কৃষিপণ্য গুদামজাতও করা যেত না। কৃষকরা তাদের শস্য পণ্যের ন্যায্য দাম পেত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক এই নতুন কৃষি সংস্কার বিল কৃষকদের সামনে সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
পাঞ্জাবের কৃষকদের মতে, তারা তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, সরকার তাদের কথা না ভেবে, তাদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনার জায়গা না রেখে এই বিল পাস করে সংসদে। তাদের মতে সরকার একপ্রকার জোরপূর্বক তাদের উপর এই বিল চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। যদিও এনডিএ সরকারের এটা স্বভাবসিদ্ধ কাজ, যা একক নেতৃত্বে ও একনায়কতন্ত্র পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া। যেখানে কৃষকদের চোখ দিয়ে তাদের পরিস্থিতি দেখার মতো বিচক্ষণতা তাদের নেই। যদিও এনডিএ সরকারের কাছে এটা কোনও নতুন বিষয় নয়। তারা যা ভাবে যা করে, সেটাই তারা ঠিক বলে মনে করে। যে জন্য তারা বারে বারে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে এই বিল কৃষকদের ভালোর জন্যই। কেউ কেউ আবার আন্দোলনকে রাজনৈতিক তকমা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের দাবি প্রতিষ্ঠায় তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাঞ্জাবের খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রসঙ্গকে টেনে আনছেন।
মাসাধিককালব্যাপী কৃষকদের এই আন্দোলন দিল্লির রাজপথে তাদের বিক্ষোভ সরকারের কাছে অনৈতিক কাজ। তাদের মতে অশিক্ষিত কৃষকরা নিজেরা নিজেদের ভালো বুঝতে সক্ষম নন, তাই তারা এই বিলের বিরোধিতা করে ভুল করছেন। সত্যিই কি তাই? সরকারের এই দাবি কি আদৌ ন্যায়সঙ্গত? যদি তাই হোত তাহলে কেন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা এই ঠান্ডায় দিনের-পর-দিন সবকিছু ছেড়ে নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছেন। আমাদের কৃষি প্রধান দেশে বিশেষত পাঞ্জাবের মতো রাজ্যের মানুষের কাছে আন্দোলন শুধু একটা আন্দোলন নয়, তাদের বেঁচে থাকার লড়াই। এটা বোঝার ক্ষমতা বোধহয় এই কেন্দ্রীয় সরকার রাখে না। না হলে, বেশ কয়েকবার কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করলেও তাদের দাবির স্বীকৃতি দিতে তারা রাজি নয়। যদিও কৃষকদের মধ্যে ‘আমরা করব জয়, নিশ্চয়’ এই মনোভাবে অটল থাকতে দেখা যাচ্ছে।
তাই কৃষক আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সরকারকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই কৃষি আইন প্রত্যাহার করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct