আপনজন ডেস্ক: করোনা যুদ্ধে অবশেষে হার মানলেন বিশিষ্ট অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের অপু চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতির আলোয় আসা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরবর্তীতে দিকপাল অভিনেতায় পরিণত হন। রবিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বেশ কিছুদিন ধরে শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো আস্তে আস্তে সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। অবশেষে শিশু দিবসের রাতে পৃথিবীকে আলবেদা বলে দিলেন এই মহান অভিনেতা। ১৯৩৫ সালে ১৯ শে জানুয়ারি এই বিখ্যাত অভিনেতা, আবৃত্তিকার এবং কবি জন্মগ্রহণ করেন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৫ বছর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্য নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছিলেন তিনি। ১৯৫৯ সালে তিনি প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয় করেন। পরবর্তী কালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মতো পরিচালকদের সাথেও কাজ করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ভিতর ১৪টিতে অভিনয় করেছেন তিনি। তার অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা বারবার প্রশংসিত হয়েছে গোটা দুনিয়া জুড়ে। প্রথম জীবনে তিনি রেডিওর ঘোষক ছিলেন এবং মঞ্চে ছোট চরিত্রে অভিনয় করতেন। ধীরে ধীরে তিনি সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি রায় নির্মিত বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন। তার অভিনীত চরিত্রগুলির ভিতরে সব থেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়েও ভাল কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তাঁর অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি ‘সোনার কেল্লা’ মুক্তি পাওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারত না। তিনি তার জীবনে অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন। তার অভিনীত সিনেমা গুলোর মধ্যে অপুর সংসার (১৯৫৯), ক্ষুদিত পাষাণ (১৯৬০), দেবী (১৯৬০), তিন কন্যা (১৯৬১), ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১), অতল জলের আহ্বান (১৯৬২), বেনারসী (১৯৬২), অভিজান (১৯৬২), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), কিনু গোয়ালার গলি (১৯৬৪), বাক্স বদল (১৯৬৫), কাপুরুষ (১৯৬৫), একই অঙ্গে এত রূপ (১৯৬৫), আকাশ কুসুম (১৯৬৫), মণিহার (১৯৬৬), কাঁচ কাটা হীরে (১৯৬৬), হাটে বাজারে (১৯৬৭), অজানা শপথ (১৯৬৭), বাঘিনী (১৯৬৮), তিন ভুবনের পারে (১৯৬৯), পরিণীতা (১৯৬৯), অপরিচিত (১৯৬৯), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), প্রথম কদম ফুল (১৯৭০), মাল্যদান (১৯৭১), স্ত্রী (১৯৭২), বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩), অশনি সংকেত (১৯৭৩), সোনার কেল্লা (১৯৭৪), সংসার সীমান্তে (১৯৭৪), দত্তা (১৯৭৬), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), দেবদাস (১৯৭৯), গণদেবতা (১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), কোণি (১৯৮৪), ঘরে বাইরে (১৯৮৪), আতঙ্ক (১৯৮৬), গণশত্রু (১৯৮৯), শাখা প্রশাখা (১৯৯০), তাহাদের কথা (১৯৯২), মহাপৃথিবী (১৯৯২), হুইল চেয়ার (১৯৯৪), পারমিতার একদিন (২০০০), দেখা (২০০১), আবার অরণ্যে (২০০২), পাতালঘর (২০০৩), পদক্ষেপ (২০০৬), দ্য বং কানেকশন (২০০৬), চাঁদের বাড়ি (২০০৭), নোবেল চোর (২০১২), মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড মোর (২০১২), অলীক সুখ (২০১৩), রূপকথা নয় (২০১৩), দূরবিন (২০১৪) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি নাট্য অভিনয় ও করেছেন,তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলো, তাপসী (১৯৬৩), নামজীবন (১৯৭৮), রাজকুমার (১৯৮৩), ফেরা (১৯৮৭), নীলকণ্ঠ (১৯৮৮), ঘটক বিদায় (১৯৯০), দর্পণে শরৎশশী (১৯৯২), চন্দনপুরের চোর (১৯৯৪), টিকটিকি (১৯৯৫) প্রভৃতি। তার এই অসাধারণ কর্মের জন্য তিনি নানান জায়গা থেকে সম্মানিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে পেয়েছেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান। ১৯৯৮ সালে পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। দু’ বার চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান, ২০০১ ও ২০০৮ সালে।
২০১২ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেছেন। ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন ২০০৪ সালে। তার এই প্রয়াণে বাংলার চলচ্চিত্র জগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct