পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হলেও স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বহুদূরে দেশের প্রান্তিক ও সাধারণ মানুষ। জয়ের উল্লাস নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে। রাম-রহিমের লড়াই ও আত্মবলিদান মুহূর্তে ম্লান হয়েছিল ধর্মের নামে দেশ বিভাজনের মাধ্যমে। তবে দেশের সাধারণ মানুষ ও স্বাধীনতা যুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যোদ্ধারা জাতপাত, বর্ণ- ধর্ম নির্বিশেষে একসাথে থাকতে চেয়েছিল। লিখেছেন ড: মুহাম্মদ ইসমাইল।
পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হলেও স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বহুদূরে দেশের প্রান্তিক ও সাধারণ মানুষ। জয়ের উল্লাস নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে। রাম-রহিমের লড়াই ও আত্মবলিদান মুহূর্তে ম্লান হয়েছিল ধর্মের নামে দেশ বিভাজনের মাধ্যমে। তবে দেশের সাধারণ মানুষ ও স্বাধীনতা যুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যোদ্ধারা জাতপাত, বর্ণ- ধর্ম নির্বিশেষে একসাথে থাকতে চেয়েছিল। কোন ভাবেই সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি দেশ ভাগ। কিন্তু কয়েকজন ধর্মান্ধ ও স্বার্থ লম্পট লোকের লালসার বসত দেশ বিভাজন হয়। তবে দেশের সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার অভাব ঘটেনি জনসাধারণের আত্মীয়তার মিলনে কিন্তু কিছু গোষ্ঠী ও সংগঠন জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,লুটতরাজ, খুন ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ফলে কাতারে কাতারে জনসাধারণ আতঙ্কিত হয়ে নিজের ভিটে মাটি ও আত্মীয় স্বজনদের স্মৃতি বিজড়িত সবকিছু ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে স্থানান্তরিত হয়। তবে তার মধ্যে ও এক অপরের আশ্রয়দাতা হিসাবে কাজ করে।নানা সংগঠন মানুষকে উৎসাহিত করে নিজেদের পছন্দমতো বসবাস করার জন্য। কারণ সুবিশাল দেশের ১০০ শতাংশ জনসংখ্যাকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি করা ছিল মুশকিল। তাই পাকিস্তানে যেমন হিন্দু জনসংখ্যা থেকে যায় তেমনি ভাবে ভারতে মুসলমানেরা শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করছে হিন্দু-মুসলমান উভয় দেশে। তবে উভয় দেশের সংখ্যালঘুরা নানা সমস্যায় জর্জরিত ও বঞ্চনার অভিযোগ করেছে বরাবর। ভারতের সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছে সাচ্চার কমিশনের রিপোর্টে। চাকরি না পাওয়া থেকে শুরু করে চাকুরিরত সকলের বঞ্চনার খতিয়ান তুলে ধরা হয়। তারপরও সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার খণ্ডন হয়নি ভারতে। তবে সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন ও তাদের উপর অত্যাচার এবং প্রভাব খাটানো থেকে আইনের ফের পাঁচে ফেলা নতুন কোন ঘটনা নয়। যা বহু যাবৎকাল ধরে চলে আসছে। অফিসে অকারণে চোখ রাঙানি, বসের আবদার ও গর্জন, সংখ্যালঘুদের হাতে খাদ্য গ্রহণ না করা, স্পর্শ থেকে শুরু করে নানা ঘটনা নিত্যদিনের ভোগান্তি। যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে কাজকর্ম না দেওয়া ও মর্যাদা না পাওয়া এমন ঘটনা ধারাবাহিক। তবে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে হুংকার ও হাক ডাক শুরু হয়েছে তা দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ভারতীয় সংবিধানের ধারা ও দেশের আইন-কানুনকে তয়োক্কা না করে সর্বভারতীয় নানা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ও ব্যক্তিগত ভাবে বহু মানুষ নিজেদের মতো করে সংখ্যালঘুদের হেনস্তা করছে বিভিন্ন প্রান্তে। গত কয়েক বছরে দেশের আইনকানুন ও সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ বেড়েছে এবং ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তিতে নানাভাবে আঘাত হানার অপচেষ্টা হচ্ছে। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন বহু জনপ্রতিনিধি। তবে ২০১৪ সালের সরকার বদলের পর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন যেভাবে উৎপাত শুরু করেছে তা নিয়ে গণতন্ত্র প্রিয় ভারতবাসী আতঙ্কিত। মাত্র ৪০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে সরকার চলছে এবং দেশের ৬০ শতাংশের বেশি জনগণ কে উপেক্ষা করে। আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র প্রিয় ও সংবিধানের ধ্যানধারণা কে বাঁচানোর পক্ষে রয়েছে। কিন্তু তারা বিভিন্ন পার্টি, দলাদলি, ধর্ম, জাতপাত, বর্ণ ও নানাভাবে বিভক্ত রয়েছে। কিছু রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও সরকারে রয়েছে। একদিকে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে কয়েকশো বছরের মন্দির, মসজিদের মত নানা বিষয়কে সামনে আনা হচ্ছে ও জনসাধারণকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে রাজনৈতিক ফায়দা ভোগ করার চেষ্টা হচ্ছে। দেশের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য পরিষেবা,বেকারত্ব,অর্থনৈতিক মন্দার মত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি থেকে শুরু করে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা নিয়ে চিন্তিত দেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। যদিও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে সিদ্ধহস্ত। বর্তমানে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ১০০° জ্বরে থরথর করছে বর্তমান নির্বাচন নিয়ে। কয়েক বছরে বিজেপির শাসন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিজেপি নিয়ে প্রচার ও প্রসার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গেছে। হিন্দু রাষ্ট্রের নামকরণ নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে বিজেপি। তারা কৌশলে ভয় দেখানো শুরু করেছে সংখ্যালঘুদের। আগামী ২০২৪ নির্বাচনে বিজেপি সরকারে আসলে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করবে এমনটাই আশঙ্কা করছেন সংখ্যালঘুরা। সেই ভয় ক্রমশ দানা বাঁধছে জোরকদমে। ইতিমধ্যে এক বিজেপি নেতা সংবিধান সংশোধনের দাবি তুলেছেন। তাই বর্তমানে সংখ্যালঘুদের দায় দেশকে বিজেপি মুক্ত করা। অবিজেপি শক্তিকে ভোট দান করার দিকে তাদের মন। ২০২৪ সালের নির্বাচন সংখ্যালঘুদের কাছে মরণপণ লড়াই যে কোন মূল্যে বিজেপিকে পরাস্ত করতে হবে। অপরপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রতিনিধিরা বারবার বলছে তাদের তো কিছু হবে না, তাদের ধর্মীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে ও দেশের ধর্ম নির্ধারণ হবে। আর সংখ্যালঘু মুসলমানেরা দেশে বসবাস করতে পারবে না ও সংবিধান পরিবর্তন করা হবে। তার ফলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সবকিছু ইসলাম ধর্মালম্বীদের বিরুদ্ধে যাবে। তাদের দেশের নতুন সংবিধান হবে হিন্দুদের আচার-আচরণ ও ধর্মীয় বিধান মানতে হবে। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিরোধী রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের এ নেয় বিজেপির বিপদ সম্পর্কে অবগত করছে। মুসলিমদিরে মনে সত্যিই আমঙ্কা দানা বেঁধেছে, হয়তো ২০২৪ সালের পর মুসলমানদের ভোটাধিকার থাকবে না এবং নতুন সংবিধান রচনা হলে তাদের দাসত্ব স্বীকার করে থাকতে হবে । ভোটাধিকার না থাকলে নাগরিকত্ব থাকবে না তাই মরতে হবে কোন অজানা আস্তানায়। তা নিয়ে বহু লোকের ঘুম হারিয়েছে অথচ সাত পুরুষের খতিয়ান বলছে তারা ভারতীয়। অন্যদিকে এনপিআর,এনআরসি নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে। অসমের এনআরসি মুসলিমদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে। হয়ত অশিক্ষা দারিদ্রতার কারণে তাদের নামে বানান ভুল রয়েছে। ভূমিহীন সামান্য মুসলমান ছাড়া সকলের কোনো না কোনো নথিপত্র রয়েছে। তার জের অসমের মুসলিমদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার চক্রান্ত চলছে। বর্তমানে ভারতীয় পরিস্থিতি আলোচনা করলে সহজেও বোঝা যায় দেশের সংখ্যালঘুরা এখন ঘোর বিপদে। যদিও যুগ যুগ ধরে প্রকৃত সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত সংখ্যালঘু এবং দলিতরা। সাচার কমিটির রিপোর্ট বলছে, স্বাধীনতার এক বছর পরও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি দেশের মুসলমানদের। তার দায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলির। তবে পরিস্থিতি পাল্টেছে। সাচার কমিটির রিপোর্ট আর্থ সামাজিক অনুন্নয়নের মধ্যে মুসলিমদের চিত্র তুলে ধরলেও, এখনকার মতো প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতার শিকার হতে হয়নি সংখ্যালঘুদের। তাই আসাম থেকে শিক্ষা নিয়ে সিএএ চালু নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ রয়েছে। এখন সিএএ চালু কারাটা সারা দেশে এনআরসি চালু করার নেপথ্য পরিকল্পনা হতে পারে। সিএএ তে প্রতিবেশী দেশে শুধু ধর্মীয় অত্যাচারের শিকার মুসলিম ব্যতিরেকে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদের ভারতে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু যারা সামাজিকবাবে নিপীড়িত ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সেই সব মুসলিমরা এ দেশে এলেও তাদেরকে নাগিরিকত্ব দেওয়া হবে না। তাই সিএএ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে পূর্ণ। তাই সাংবিদানিকভাবে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এন আর সি ও এনপিআর হলে হিন্দু সমাজের বৃহত্তর অংশ বিপদে পড়বে কারণ তারা ভারতের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো উন্নয়নে প্রলুব্ধ হয়ে বাংলাদেশ থেকে কাতারে কাতারে ভারতে বসবাস শুরু করেছে। তাদের মধ্যে বহু লোক আজও ওপার বাংলা থেকে বাড়ি ভাড়া ও পেনশনের টাকা নিয়ে আসছে অথচ বসবাস করছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। ভারতে বসবাসকারী বৃহত্তর হিন্দু জনগণ বিপদে পড়বে, নাগরিকত্ব হারাবে ও জান মাল বাজেয়াপ্ত হবে। সংখ্যালঘুদের উচিত প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করে রাখা অন্যদিকে শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য সহ নানা কাজে মনোনিবেশ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কারণ এই দেশ কোন নেতার নয়, বা কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। মনে রাখতে হবে সকলের দেশ, এমন দল ও নেতা কালের নিয়মে চলেও যাবে। কিন্তু ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যময়তা যুগ যুগ ধরে বিরাজ করবে। তাই সংখ্যালঘুদের আতঙ্কিত না হয়ে, সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে নিজেদের উন্নয়ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আবেদন করতে হবে। আর সাম্প্রদায়িক দলকে বিদায় জানাতে হবে নিজেদের শর্মীয় স্বাধীনতা বজার রাখার স্বার্থে। তবেই সামগ্রিক ভাবে সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন হবে।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল, সহকারী অধ্যাপক, দেওয়ান আব্দুল গণি কলেজ, দক্ষিণ দিনাজপুর
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct