বিস্মৃত এক দেশনায়ক মাওলানা আজাদ
ড. নূরুল ইসলাম
শেক্সপিয়ার তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি টুয়েলফথ্ নাইট নাটকে একটি অবিস্মরণীয় উক্তি করেছেন, “কিছু মানুষ মহানতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। কিছু মানুষ মহানতা অর্জন করেন। আর কিছু মানুষের উপর মহানতা আরোপ করা হয়।” প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে উচ্চারিত এই উক্তি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বর্তমান ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিদিন এরকম কত নক্ষত্রের ও কৃত্রিম উপগ্রহের আবির্ভাব হচ্ছে ও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে! মহিউদ্দিন আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) ছিলেন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নক্ষত্র। তিনি ছিলেন ভারত উপমহাদেশের অন্যতম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক, লেখক, প্রভাষক ও সমাজসংস্কারক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপোষহীন যোদ্ধা। অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামী। প্রথম শ্রেণির দেশনির্মাতা। তিনি ছিলেন অখণ্ড ভারত উপমহাদেশের আমৃত্যু প্রবক্তা। তিনি ছিলেন সর্বজন স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ইসলামী চিন্তাবিদ। দ্বিজাতি তত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপোষহীন যোদ্ধা। মাওলানা আজাদ ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সম্ভবত অতীতে তো নয় এপর্যন্ত সেই মর্যাদা কোনো আলেম বা ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক অর্জন করতে সক্ষম হননি। তাঁর পান্ডিত্য ছিল সর্বজন স্বীকৃত। বিশ্ব নন্দিত। তিনি ছিলেন কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও ইসলামী ইতিহাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অসাধারণ প্রতিভা। আধুনিক সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, দর্শন ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অনন্য পন্ডিত। পন্ডিত নেহরু তাঁকে গুরুজী বলতেন। গান্ধীজি তাঁর পান্ডিত্য ও নেতৃত্বকে সমীহ করতেন। সমকালের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁর মনীষাকে সমীহ করতেন। অধুনা লুপ্ত প্লানিং কমিশনের বরিষ্ঠ সদস্যা সাইয়েদা সাইদাঈন হামিদ সম্পাদিত ও ভারত সরকার প্রকাশিত India’s Maulana: Maulana Abdul Kalam Azad গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে মাওলানা আজাদ সম্পর্কে সমকালীন প্রথম শ্রেণির রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বরেণ্য মনীষীদের মূল্যবান বক্তব্য। গান্ধীজি, নেহরুজি, প্যাটেলজি, রাজেন্দ্র প্রসাদজি, সরোজিনী নাইডুজি, কৃপালিনীজি, কে নেই? দেশের প্রথম সারির প্রায় ২৫ জন দার্শনিক-রাজনৈতিক নেতা তাঁদের অকপট স্বীকারোক্তি ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছেন। সকলেই তাঁর মনীষার প্রশংসা করেছেন।
রাজনৈতিক দূরদর্শিতা
লক্ষণীয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্দিষ্ট নেতার চাটুকারিতা ও অন্ধভক্তি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বর্তমানে মোদিজির প্রতি এক শ্রেণির মানুষের এবং নিচু তলার নেতৃত্বের চাটুকারিতা ও অন্ধভক্তি দেখে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন। অথচ এটা একটি স্বাভাবিক এবং দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত প্রথা। গান্ধীজির নেতৃত্বের প্রতি এক শ্রেণির মানুষের ও নেতাকর্মীদের ছিল অন্ধভক্তি ও চাটুকারিতা। বস্তুত নেতারা তাদের পার্ষদ নির্মাণ করেন এই ধরণের মানুষদের নিয়ে। মাওলানা আজাদ ছিলেন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন স্বভাবজাত স্বাধীনচেতা। এজন্য কেউ কেউ তাঁকে উন্নাসিক ও উদ্ধত বলেছেন। কিন্তু না। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও আদর্শের অনুসারী ব্যক্তি কখনই অন্ধভক্ত ও চাটুকার হতে পারে না। মাওলানা আজাদ একমাত্র ব্যক্তি যিনি গান্ধীজিকে ও নেহরুজিকে চরম শ্রদ্ধা করা সত্ত্বেও তিনি তাঁদের অন্ধভক্ত ছিলেন না। তিনি তাঁদের বহু সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তা সত্ত্বেও, তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কমেনি। বরং স্বাধীন ভাবনার জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছেন।
১. মাওলানা আজাদ গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। কিন্তু তিনি অহিংসাকে অলঙ্ঘনীয় আদর্শ মনে করতেন না। প্রতিপক্ষ অহিংস হলে অহিংসা কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। যদি প্রতিপক্ষ অহিংসাকে শ্রদ্ধা না করে তাহলে হিংসা ছাড়া আন্দোলন সফল হতে পারে না। একটি বিচ্ছিন্ন সহিংসতার জন্য গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন পরিত্যাগকে তিনি মানতে পারেননি। এই সিদ্ধান্তকে তিনি হঠকারিতা মনে করতেন।
২. দেশভাগের সিদ্ধান্তকে তিনি আমৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। গান্ধীজি ও নেহেরুজি মেনে নিলেও তিনি এই সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকার করেন। তিনি কোনো দিন মানেননি। তিনি মনে করতেন, দেশভাগের সিদ্ধান্ত মেনে নিলে সাময়িক আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করা হবে। দেশভাগ ভারত উপমহাদেশের তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হলেও এভাবে সাম্প্রদায়িকতার চিরস্থায়ী সমাধান হবে না। তিনি মনে করতেন, অচিরেই দেশভাগের অসাড়তা প্রমাণ হবে।
৩. নেহরুজিকে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। তা সত্ত্বেও, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা বিষয়েও তিনি সহমত ছিলেন না। এমনকি তিনি অকপটে বলেছেন, প্যাটেলজিকে প্রধানমন্ত্রী করলে দেশভাগ আটকানো যেত।
৪. তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশভাগ হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষের পরিসমাপ্তি ঘটাবে না। বরং তা আরো দীর্ঘায়িত হবে। তিনি বলেছিলেন, “আকাশ থেকে ফেরেশতা নেমে এসে কুতুব মিনারের শীর্ষ চুড়া থেকে যদি চিৎকার করে বলে, ‘তোমরা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ থেকে সরে এসো। তাহলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে স্বাধীনতা দেওয়া হবে।’ আমি বলব, স্বাধীনতার সময় পিছিয়ে যাক। কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। স্বাধীনতার সময় পিছিয়ে গেলে শুধু ভারতীয়দের ক্ষতি হবে। আর হিন্দু -মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট হলে সমগ্র মানবতার ক্ষতি হবে।”
৫. তিনি বিশ্বাস করতেন, পাকিস্তান শব্দটি ভুল। পাকিস্তান ধারণাটি ভ্রান্ত। পাকিস্তান মুসলিম সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রক্ষার রক্ষাকবচ হতে পারে না। পাকিস্তানের অস্তিত্ব দীর্ঘস্থায়ী হবে না। পাকিস্তান একটি আবেগ। পাকিস্তান দাবি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রতিক্রিয়া। পাকিস্তান হবে মুসলিম এলিট শ্রেণির জমিদারি।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপোষহীন যোদ্ধা
এবিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমরণ আপোষহীন লড়াই করে গেছেন। একথা তাঁর শত্রু এবং মিত্র সকলেই স্বীকার করেন। তিনি মিশ্র জাতীয়তাবাদের নিরলস প্রবক্তা ছিলেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের চরম বিরোধী ছিলেন। হিন্দু ও মুসলিম ঐক্যের প্রবক্তা ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি কেন আজ বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছেন? পরিতাপের বিষয়, যে ব্যক্তি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই করেছেন তিনি আজ সাম্প্রদায়িকতার বলি! অনেকেই অভিযোগ করেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম পরিচিতি বিলুপ্তির যে যজ্ঞ শুরু করেছে তার শিকার মাওলানা আজাদও। মৌলবাদী মুসলিম, ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম এবং বিজেপির বশ্যতা স্বীকারকারী মুসলিম কেউই এখন রেহাই পাচ্ছে না। সেকেন্দার বখত থেকে শাহনাওয়াজ ও নাকভিরা তাদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কি না করেছে? কিন্তু কেউই তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। নির্দিষ্ট সময় পর তারা তাদের সকলকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। মুসলিম মুক্ত সরকার নির্মাণের প্রকল্প এখন একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়েছে। মুসলিম মুক্ত রাজনৈতিক দল গঠন সম্ভব হয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, খুব শীঘ্রই মুসলিম মুক্ত বিচার বিভাগ গঠনের প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হবে। এমনকি অচিরেই মুসলিম মুক্ত নির্বাহী বিভাগ গড়ে উঠবে। ‘সাব কা বিশওয়াশ ওর সাব কা বিকাশ’ স্লোগান কিয়া আইওয়াশ?
মুসলিম পরিচিতি বিলুপ্তির পথে?
স্মরণীয়, ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণে মাওলানা আজাদের অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করে পূর্ববর্তী ইউপিএ সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী অর্জুন সিং মাওলানা আজাদের জন্মদিনটিকে জাতীয় শিক্ষাদিবস ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু হায়! ভাগ্যের কি পরিহাস! ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সরকারি বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা সরকার ঘোষিত শিক্ষা দিবস অবলীলায় অবজ্ঞা করে চলেছে। দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঐদিন শিক্ষা দিবস উদযাপন করে না। কারণ স্পষ্ট। এই হচ্ছে একজন দেশপ্রেমী ও দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানের পরিণতি। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান বিজ্ঞানী ও মিসাইল ম্যান এপিজে আবদুল কালামও শীঘ্রই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবেন। নিশ্চিত। কোনো সন্দেহ নেই। কারো অভিমান এবং আক্ষেপ এই পরিণতি থেকে মুসলিমদের রক্ষা করতে পারবে না।
(লেখক মাওলানা আজাদ গবেষক ও হীরালাল ভকত কলেজের অধ্যক্ষ)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct