সাহিত্য সভায়
শীলা সোম
সাহিত্য জগতের প্রথম সারির লেখিকাদের মধ্যে অন্যতম লেখিকা কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর চতুষ্কোণ, বেদেনীর প্রেম, শবরীর প্রতীক্ষা বেশ নাম করে ফেলেছে। সাড়া জাগানো উপন্যাস বিধুমুখীর সংসার এখন লোকের মুখে মুখে। অল্প স্বল্প লিখে উদীয়মান লেখিকা অয়ন্তিকা সামান্য নাম করলে ও তার লেখনীতে যাদু আছে। এত সুন্দর লেখা পড়ে বঙ্গবাসী আপ্লুত। আজ প্রাক শারদীয়ার মুহুর্তে বাঁকুড়ার এক সাহিত্য সভায় আমন্ত্রিত অয়ন্তিকা বসু। গাড়ি ছুটে চলেছে তার নিজস্ব গতিতে। কত জন নামছে, উঠছে কোনো দিকে অয়ন্তিকার নজর নেই। তিনি একটা স্ক্রিপ্ট লিখতে ব্যস্ত। হঠাৎই একটা আচমকা ধাক্কা, অয়ন্তিকা বসুর হাত গেলো কেঁপে, কিছু বোঝার আগেই কি এক অজানা ভয়ে মনটা কেমন করে উঠলো। গাড়ী আর চলছে না। এইভাবে বেশ কিছু সময় কেটে গেলে, অগত্যা অয়ন্তিকা বসু প্লাটফর্মে নেমে আসেন, সেখানেই একটা খালি বেঞ্চে বসে আবার তিনি লিখতে শুরু করেন। পাশে দন্ডায়মান এক ভদ্রমহিলা, মহিলা বলাই ভালো, তাকে জিজ্ঞাসা করলো তাঁর পাশের সীট কী খালি? বিরক্তির স্বরে অয়ন্তিকা বলে উঠলো দেখছেন তো খালি,বলে মহিলার দিকে তাকালেন।সাদামাঠা এক মহিলা পরণে তাঁতের শাড়ি, চুলটা আলগা খোঁপা করা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। প্রৌঢ় বলা যেতেই পারে।বসে পড়ুন বলে নিজের কাজে মন দিলেন। একটু পরেআবার মহিলা বললেন একটু চা খেলে ভালো হতো বলে চাওয়ালাকে ডাকলেন। বলছি, লেখা লেখি তো করছেন মাথা খুলবে চা খেলে। বিরক্তির দৃষ্টিতে অয়ন্তিকা বলে উঠলো না না আমি বাইরের কোনো কিছু খাইনা। মহিলা হেসে বললেন অগত্যা একটাই দাও হে। বলে রসিয়ে রসিয়ে চা খেয়ে ভাঁডটা সামনে রাখা বিনে ছুঁড়ে ফেললেন।
কিছুক্ষণ পরে অয়ন্তিকা তার সুদৃশ্য ব্যাগ থেকে ফ্লাক্স বের করে চা খেয়ে আবার লেখায় মন দিলো। মহিলা তাকে আর কিছু বললো না।ইতিমধ্যে, খবর হয়ে গেলো, গাড়ী আবার চলবে, সবাই যে যার সীটে বসে পড়লো। ট্রেন আবার ছুটে চললো, শেষ স্টেশন আসতেই সবাই সচকিত হয়ে উঠলো। প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই অয়ন্তিকা দেখলো কারা যেন ছোটাছুটি করে কাকে খুঁজছে। সে ভাবলো তাকেই বুঝি! কিন্তু কই? সে তো হাত নাড়তে নাড়তে নেমে গেলো, কেউ তো এলোনা। তাহলে কোনো মন্ত্রী টন্ত্রী হবে, আজকাল তো সবেতেই রাজনীতি, এই করেই দেশটা গেলো। স্টেশন থেকে বেড়িয়ে একটা ট্যাক্সি করে অয়ন্তিকা পৌঁছে গেলো তার কাঙ্খিত জায়গায়। তাকে সমাদরে মঞ্চে বসানো হলো। ফুলের তোড়া দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হলো। সভায় কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আমন্ত্রিত শুনে অয়ন্তিকার শিরদাঁড়া টানটান হয়ে উঠলো। হৈ চৈ শুনে বুঝতে পারা গেলো তিনি এসে পৌঁছেছেন। সবাই দরজার দিকে তাকিয়ে আছে তাঁর ই প্রতীক্ষায়। কিন্তু একী? কাকে দেখছে অয়ন্তিকা! ভূমিকম্প হলে ও এতটা সে চমকাতো না। এ তো ট্রেনের সেই মহিলা, যাকে সারাটা ক্ষণ তাচ্ছিল্য করে ই এসেছেন। তাঁকে সমাদরে আসন গ্রহণ করতে বলা হলো। ফুলের তোড়া দিয়ে সম্বর্ধিত করা হলো। লাউডস্পিকারে ঘোষিত হলো কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কে উত্তরীয় দিয়ে সম্বর্ধিত করবেন নবাগতা লেখিকা অয়ন্তিকা বসু। কী আর করে অয়ন্তিকা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় তাঁর দিকে। পরম শ্রদ্ধা ভরেই উত্তরীয় পড়িয়ে ধীর পদক্ষেপে আসন গ্রহণ করা ছাড়া আর কী বা থাকতে পারে! কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হলো। তিনি বিনীত ভাবে সকলের কাছে ক্ষমা চাইলেন দেরী তে পৌঁছানোর জন্য। তারপর তিনি বলতে শুরু করলেন, একজন ভালো লেখক হবার আগে তাকে একজন ভালো মানের মানুষ হতে হবে। মানুষের অন্তরের কথা তবেই তো তিনি সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করতে পারবেন। মরমে মরে যাচ্ছিল অয়ন্তিকা, তিনি বলে চললেন আজ বিশ্বায়নের যুগে ও সাহিত্যপ্রেমী মানুষের সংখ্যা কম নয়। কলমকে হাতিয়ার করে যাঁরা এগিয়ে চলেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম, আমার পাশেই আসন অলংকৃত করে আছেন অয়ন্তিকা বসু, ইন্দিরা রায়, আলতাফ হোসেন প্রমুখ। চমকে ওঠে অয়ন্তিকা উনি আমাকে চেনেন তবু আত্মপরিচয় না দিয়ে অবহেলা সহ্য করলেন। আর সে দু পাতা লিখতে না লিখতেই অহমিকার আবরণে নিজেকে মুড়ে ফেলেছে। আজ সাহিত্য সভায় এসে তার সব অহমিকা এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো, এবার থেকে জন্ম নেবে এক নতুন অয়ন্তিকা, তার প্রেরণার উৎসস্থল কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct