সুভাষ চন্দ্র দাশ, সুন্দরবন, আপনজন: প্রত্যন্ত সুন্দরবন। বয়ে চলেছে দত্তপশুর নদী। নদীর একতীরে ঘন জঙ্গল,সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গলের আস্তানা। অপর দিকে রয়েছে লোক বসতি গ্রামাঞ্চল। এলাকায় রয়েছে রজতজুবিলির ১৩ নম্বর অ্যানপুর গ্রাম। সেখানকার জমিদার পরেশ মন্ডল। এদিকে সুন্দরবনের গোড়াপত্তনকারী স্যার ডেনিয়্যালল হ্যামিলটন সাহেব সুন্দরবনের মানুষের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজে ব্রতী হয়েছেন। যার ফলে সুন্দরবনের গোসাবার বিভিন্ন এলাকার জমিদারদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে।সালটা বাংলা ১৩৫৩। আজ থেকে প্রায় ৭৭ বছর আগে।শীতের মরশুম। মাঠের মধ্যে সোনালী ধানে ভরপুর। আচমকা দত্তপশুর নদী সাঁতরে ১৩ নম্বর অ্যানপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। খবর চাউর হতেই গ্রামের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যায়।ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ে গ্রামের মানুষ। বাঘের হাত থেকে কি ভাবে পরিত্রাণ পাবেন সেই চিন্তায় গ্রামের মোড়ল মাতব্বর সহ সমস্ত গ্রামবাসীদের খাওয়া-দাওয়া সহ রাতে ঘুম উবে যায়।ঘটনার কিছুদিন আগেই গ্রামের জমিদার পরেশ মন্ডল একটি বন্দুক কিনেছিলেন জঙ্গলে হরিণ শিকার করার জন্য। গ্রামের সমস্ত মানুষজন পরেশ মন্ডলের বাড়িতে হাজীর হলেন।গ্রামবাসীরা দাবী করলেন যেনতেন প্রকারে বাঘের হাত থেকে গ্রাম কে রক্ষা করতে হবে।বাঘের কবল থেকে গ্রামবাসীদের জীবন রক্ষা করার জন্য পরেশ মন্ডলের নেতৃত্বে সুরেন্দ্র নাথ মন্ডল, গণেশ চন্দ্র সরকার, অশ্বিনী কুমার মন্ডল, ধীরেন্দ্র নাথ মন্ডল, ক্ষেত্রমোহন সরকার, অশ্বিনী কুমার সরকার,দুর্গা মন্ডলদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। বন্দুক আর ৭ সঙ্গীকে নিয়ে বাঘ শিকারে বেরিয়ে পড়েন। মাঠের ধানক্ষেতে শুরু হয় বাঘে মানুষের লুকোচুরি খেলা। এমন ভাবে কয়েকদিন চলার পর ধানক্ষেতের মধ্যে বাঘ কে সামনে পেয়ে যায় পরেশ মন্ডল ও তাঁর দলবল। ব্যাস,আর এক মুহূর্ত দেরী না করে বন্দুক তাক করে পর পর তিনটি গুলি চালিয়ে দেন বাঘের শরীরে। কুপোকাৎ হয়ে পড়ে জঙ্গলের মহারাজ বাঘ মামা। বন্দুকের গুলিতে বাঘ মারা পড়েছে জানতে পেরে গ্রামের লোকজন ভিড় জমায় বাঘ দেখার জন্য। আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন গ্রামবাসীরা। ধন্য ধন্য রব ওঠে পরেশ মন্ডল ও তাঁর সঙ্গীদের নামে। বাঘ মারার পর মৃত বাঘ নিয়ে সোজা হাজীর হন স্যার ডেনিয়্যাল হ্যামিলটন সাহেবের অফিসে। সেখানে মৃত বাঘকে সামনে রেখে স্যার ডেনিয়্যাল হ্যামিলটন সাহেবকে পাশে নিয়ে একের পর এক ছবি তোলেন পরেশ ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা। তৎকালীন সময়ে এমন বীরত্বের জন্য পরেশকে পাঁচ বিঘা জমি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন হ্যামিলটন সাহেব। যা সুন্দরবনের বুকে এক বিরল ইতিহাস।
বাঘ শিকার দলের অন্যতম সদস্য সুরেন্দ্র নাথ মন্ডলের বড় ছেলে প্রফুল্ল মন্ডল। প্রফুল্ল তৎকালীন সময়ে অষ্টম শ্রেণী পাশ করেছিলেন। বাংলা বিষয়ের থেকে ইংরাজী বিষয়ে বেশ দক্ষতা অর্জন করলেও সরকারি ভাবে কোন কাজ না পেয়ে বাবার দেখানো পথ অবলম্বন করেন। প্রফুল্ল মন্ডলও একজন শিকারী হয়ে ওঠেন। সুন্দরবনের জঙ্গলে বেশ কয়েক বার বাঘের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তবে বাঘ শিকার করতে না পারলেও বাঘকে তাড়িয়ে গভীর জঙ্গলে ফেরত পাঠিয়েছেন প্রফুল্ল। ৮৩ বছরের বৃদ্ধ প্রফুল্লর তিন সন্তান প্রবীর, প্রশান্ত,প্রণব। বিভিন্ন রোগে তিনজনই অকালে মারা গিয়েছে। বর্তমানে প্রফুল্ল, স্ত্রী বিশাখা, পুত্রবধু রুপা ও এক নাতিকে নিয়ে সংসার। পুত্রশোকে জর্জরিত প্রফুল্ল বাবার সেই স্মৃতিবিজড়িত ঘটনার ছবি বুকে করে আগলে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রফুল্ল’র কথায়, “বাবা ও তাঁর সঙ্গীরা বাঘ মেরে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন, পুরস্কার জুটেছিল। সেটা ছিল খুব আনন্দের।আমিও একজন দক্ষ শিকারী হতে চেয়েছিলাম। সেটা সম্ভব হয়নি। এরই মাঝে অকালে তিন সন্তানকে হারিয়েছি। দুঃখ শোকে পাথর হয়েগিয়েছি। মাঝে মধ্যে সেই দুঃখ যন্ত্রণা ভুলতে বাবার স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছি।”অন্যদিকে সুন্দরবনের এই ১৩ নম্বর অ্যানপুরের পাথরপাড়া থেকে অবিরাম বয়ে চলেছে দত্তপশুর নদী। ঠিক তেমনই ভাবে বাবার কৃতিত্বের ছবি বুকের মধ্যে আঁকড়ে রেখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে পুত্রশোকের কথা ভুলতে চাইছেন প্রফুল্ল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct