কপোতাক্ষের টানা পোড়েন
মোঃ আব্দুর রহমান
একটা কই মাছ পানির উপরে এক হাত লাফিয়ে উঠতেই চিৎকার করে উঠলো সিয়াম,” দেখো মা একটা কই মাছ! ছেলের কথা শুনলো ঠিকই, ওভাবে আর কপোতাক্ষের দিকে তাকালো না কুসুম। কারণ কুসুমতো ঝিমিয়ে পড়েছে আজ তিনটি বছর আগেই। এই কুসুম আর সেই তিন বছর আগের কুসুমের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। যাঁর মাথায় বেনী নেই, পায়ে নূপুর নেই, মুখে হাসিও নেই! তবে শ্রাবন বিকেলের রবি মামার লালচে আলোতে চোখের কোনে এক ফোটা চকচকে জল আছে, আর আছে আউলা বাতাসে মুখের উপর থুবড়ে থাকা এক গুচ্ছো এলো চুল। একদিন অবশ্য এই চুলের বাহারি খোপাটার কারণেই কতো যুবকের কাজকর্মে হতো ভুল। কিন্তু সেই চুলের দিকে অবশ্য আজকাল কোন খেয়াল নেই কুসুমের। থাকার কথাও নয়।কারণ যে মানুষটির জন্য একসময় সব কিছু পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে চলতো। সে মানুষটি কিন্তু আজ আর নেই! তিন বছর আগে করোনায় ঝরে পড়েছে সেই কদম। হ্যাঁ, কদম তাঁর স্বামীর নাম। যে রেখে গেছে দুটি ফুটফুটে আশা এবং আকাঙ্খা - তারা হলো সিয়াম ও সোহান। কুসুমের শূন্য বুকের এপাশ ওপাশ আর কী।দুজনেই দেখতেও মাশআল্লাহ মন জুড়িয়ে যায়। আর সেই দুই ছেলেকেই সঙ্গে নিয়ে রোজ এসে বসে এই কপোতাক্ষের পাড়ে। যেই নদটা তার জীবনের ছোট থেকে বড় পর্যন্ত অনেক সুখ-দুঃখের স্বাক্ষী। এছাড়াও কবির ভাষায় নদী আর নারীর সাথে মিতালীটাতো অনেক আগের। যার বাস্তবতাটা ফুটে উঠেছে কুসুমের বেলায়।মাঝখানে কপোতাক্ষ অবশ্য ধুকে ধুকে প্রাণ হারাতে বসেছিল। আর তখন কতই না কপোতাক্ষের তীরে বসে কুসুম এবং কদম আফসোস করতো ! আহা এই নদটাকে যদি আবার বাচানো যেতো। আবার যদি জল টলমল করতো, মাঝি মাছ ধরতো আর তার পাশে বসেই কদম আর কুসুম খুনসুটিতে হাসতো এবং একে অন্যের গায়ে পানি ছিটাতো..।হ্যাঁ, সরকারের সুদৃষ্টিতে কপোতাক্ষকে পুনরায় খনন করা হয়েছে। আবারও নাও ভাসছে, মাছ ধরছে, পানিও টলমল করছে। এমন কী ওরাও তিন মা ছেলেও এসে বসেছে কপোতাক্ষের পাড়ঘেষে। কিন্তু দুঃখের বিষয় নদটার সাথে কুসুমের চোখটাও আজ টলমল করছে । কারণ পাশে নেই.. কদম!তবে এ চোখটা যে, শুধু কদমের অভাবেই টলমল করছে সেটাও কিন্তু ঠিক নয়। হয়তো স্বামীর বিয়োগান্তে যে আশা নিয়ে বাপের বাড়ি নাও ভিড়িয়েছিলো কপোতাক্ষের কন্যা; এদের কাছে সেই কদর হয়তো আজ তার নেই। আসলে থাকেও না। কেউ করেও না। কারণ তো একটাই- তৈল আলার মাথায় সবাই তৈল দেয়, তৈল না থাকলে মুদ্রার উল্টো পিঠ!এই যেমন একটু আগেও সোহান ওর মামাতো ভাই জনির সাথে খেলতো গেলে, জনির মা জনিকে ঘরে নিয়ে যায়! অবশেষে সোহান কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে বসে এক বেলা জুড়ে নালিশ করতে থাকে। আবার সিয়াম যখন এসব পরিবেশের তিক্ততা পেতে পেতে বড় এক নিঃশ্বাস ছেড়ে এক সময় বলে বসে, আমার কাছে দাদার বাড়ীটাই ভালো লাগতো, কেন যে এখানে এলাম! আর সাথে উড়ে এসে জুড়ে বসার কারণে বরাবরই উপেক্ষিত কুসুমের মনটা যে, চন্দন কাঠের মতো সব সময় পোড়ে; সেটা ঐ টলমলে চোখ জোড়াই রাজ স্বাক্ষী দেয়। তবে একদিন কিন্তু এবাড়ীতে কুসুমের রাশি রাশি কদর ছিল, কারণ তখন যে কদমেরও কারি কারি বিদেশি টাকা ছিল। আসলেও কুসুমের অংকের সূত্রটা বসানো ঠিক ছিল না তাই উত্তরটাও মিলছেনা। এখন সেই প্রাণ ফিরে পাওয়া কপোতাক্ষের তীরে বসেই নতুন সূত্র বসানোর চেষ্টা করে চলেছে দুই ছেলেকে নিয়ে। অবশ্য এই নদটার সাথে ওর আরও একটা গোপন সুসম্পর্ক আছে। এই নদটা কুসুমদের বাড়ীর পাশ দিয়ে যেভাবে গিয়েছে। ঠিক বারো গ্রাম পেরিয়ে কদমদের বাড়ীর সামনে দিয়েও একইভাবে অতিক্রম করেছে। তাই শূন্যবুকে তৃষ্ণা মিটাতে এই কপোতাক্ষের পাড় ছাড়া কোন উপায় নেই কুসুমের। বাকীরা সব যার যার। তারপরও যতটুকু স্নেহের পরশ পায় সেটা বৃদ্ধ বাবা-মা’র। কারণ তাঁরাতো আর সন্তানকে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু, উনারাই বা আর কতদিন বাঁচবেন! তাইতো কুসুমের চিন্তা হয়! ভয় হয়! সবাই থেকেও নিজেকে একা মনে হয়! এদিকে ওরা তিন মা ছেলে কিন্তু কপোতাক্ষের পাড়ে মোটেই একা আসে না। সাথে আরও কতগুলো নতুন সদস্য যোগ হয়েছে। যারা এই পরিবারের একান্ত সদস্য। যেমনঃ সাতটি পাতিহাঁস যার মধ্যে একটি আবার হাঁসা। তিনটি তরতাজা খাসি এবং বেশ কিছু মুরগি । হাঁসগুলি এখন ডিম পাড়ে, সাথে কিছু মুরগিও ডিম পাড়ে তবে একটি ডিমও বিক্রি করে না কুসুম। সবগুলি ওর ছেলেদের খাওয়ায় আর সাথে বাবা-মাকেও দেয়। তবে কিনতে হয় না। আবার মাঝে মাঝে বাচ্চাও ফুটায়। মাংসটাও এখান থেকেই চলে আসে।
খাসি গুলি বিশ হাজার করে দাম উঠেছে। আবার ঘরের কোনে একটি সেলাই মেশিনও আছে। তাতেও সেলাইয়ের কাজটা করে কিছু রোজগার করে কুসুম। এভাবেই সিয়াম-সোহানের বাবার দায়িত্বটা পালন করে চলেছে কপোতাক্ষের কন্যা। কপোতাক্ষের কাছ থেকেই ভাঙ্গা-গড়ার এই খেলাটা বেশ রপ্ত করেছে সে। কপোতাক্ষের মতো একদিন তার সংসারেও আবার শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরে আসবে এটাই কুসুমের স্বপ্ন। তাইতো আজও ছেলেদের কোন অভাব সে বুঝতে দেয় না। যতটুকু পারে আদর যত্নে রাখে। অভাবেও হাত পাতে না, কারো কাছে মাথাও নত করে না। স্বপ্ন একটাই ছেলেগুলিকে মানুষ করা। কদমের স্বপ্নগুলি পূরণ করা। তবে কুসুম যতই কাঁদতে চায় না কেন; এই সোনার টুকরো দুটির জন্য পারে না। এবার এলো চুলগুলো সরিয়ে ছোট্ট সোহান বলছে, “মা কাঁদছো কেন? বাবার কথা মনে পড়েছে।” জবাবে মাথাটা নাড়িয়ে এক চিলতে বাসী হাসি দিয়ে বললো না বাবা। যাও, তুমি হাঁসগুলি তাড়িয়ে নিয়ে আসো বাড়ী যাবো। মায়ের অনুমতিতে অগ্রসর হতে থাকলো ছোট্ট সোহান। যদিও পা টা একটু টেনে টেনে হাঁটছে। সেটা দেখেই আর এক ঝটকা বেদনার জোয়ার প্লাবিত হলো কুসুমের বুকটায়। কারণ কয়েকদিন আগেই একটি যাত্রীবোঝাই ভ্যান ছেলেটার পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। তারপরও সুখের বিষয় অন্তত সোহানটা হাঁটতে পারছে। ডাক্তার বলেছে আস্তে আস্তে পুরোটাই ঠিক হয়ে যাবে। কথাটা ভেবেই আবার যখন চোখটা টলমল করছে, তখন সিয়াম বললো- মা, কী হলো আবার কাঁদছো কেন! তোমাকে না কতবার বলেছি কাঁদবে না। এবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও জোর করে আর এক চিলতে হাসি হেসে বললো,” যাও বাবা বেলা গড়াতে গেলো খাসি তিনটা নিয়ে আসো আমরা এখন বাড়ী যাবো। ঠিক যখন ওরা সবাই মিলে পাড়ে উঠেছে, তখন সূর্য্যিমামাকেও পশ্চিম আকাশ হজম করেছ। কিন্তু সিয়াম হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বললো, মা দেখো দেখো কদম! বিজলী চমকের মতো দ্রুত লাফিয়ে উঠে পিছনে তাকালো কুসুম! কিন্তু কাউকে দেখতো পেলো না। একটু হতাশা নিয়েই বললো,”কোথায় বাবা? “ অবশেষে সিয়াম কদম গাছটাকে দেখিয়ে বললো ওই দেখো মা কি সুন্দর কদম ফুটেছে! যদিও নিরাশ হলো তারপরও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বুকে শূন্যতাটা চাপা দিয়ে বললো, হ্যাঁ, বাবা খুব সুন্দর! বর্ষার কদম। পুরো কপোতাক্ষটাই আজ খুব সুন্দর লাগছে। চলো বাবা পড়তে বসবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct