যার কবিতার ভক্ত ছিলেন জার্মানির কবি গেটে থেকে বাংলার রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা অটল বিহারী বাজপেয়ীও
মহাকবি হাফিজ সিরাজী
প্রিয়ার গালের একটি তিলের জন্য বোখারা আর সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যিনি, তিনি খাজা শামস-উদদীন মোহাম্মদ হাফিজ-ই-সিরাজী। পারস্যের সুফি কবি। পারস্যের (বর্তমান ইরান) সিরাজ শহরে কবি হাফিজ সিরাজী মোসল্লা নামক স্থানে চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জন্মগ্রহণ করেন। এই ইরানি কবিকে বুলবুল-ই-সিরাজ বলা হত। এই মহানকবি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন ফৈয়াজ আহমেদ..
প্রেম-সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতার সবচেয়ে মহিমান্বিত কণ্ঠস্বর হাফিজ শিরাজি। যিনি ইরানিদের কাছে বুলবুল, অদৃশ্যের কণ্ঠস্বর আর পৃথিবীর মানুষের কাছে অনন্ত প্রেম, অযুত রহস্যের মর্মসন্ধানী হিসেবে পরিচিত। তাঁর প্রতি নিরবচ্ছিন্ন আকর্ষণ অনুভব করেছেন জ্ঞানপিপাসু ও সাহিত্যপ্রেমীরা। জার্মানির জাতীয় কবি গেটে মহাকালের মহাকবি হাফিজ পাঠে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলছেন- Hafiz! Lets share all joy and woe, as true twin brothers, one from two. দেশ-কালের ব্যবধান ঘুচিয়ে গেটে তাকে নিজের জোড়ভাই বলে সম্ভাষণ জানিয়েছেন। হাফিজের সাহিত্যকর্ম ওরিয়েন্টালিস্ট জোসেফ ভন হ্যামার কর্তৃক ১৮১২ সালে জার্মান ভাষায় প্রথম অনূদিত হয়। গেটে কিছুটা বৃদ্ধ বয়সে অর্থাৎ ৬৫ বছর বয়সে হাফিজের অনূদিত লেখা পড়ে অভিভূত ও মোহবিষ্ট হয়ে পড়েন। হাফিজের দিওয়ান (Divan) তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, আর সে আলোকে তিনি লিখে ফেললেন ১২ খণ্ডের অনন্য সাহিত্যকর্ম West Eastern Divan (the parliament of East and West. শুধু তা-ই নয়, হাফিজের অসাধারণত্ব প্রকাশে তিনি বলেন- Hafiz has no peer.পাশ্চাত্যের তাবৎ কবি সাহিত্যিকের গুণমুগ্ধ মহাকবি হাফিজের আসল নাম শামসুদ্দীন মোহাম্মদ। তিনি কোরআনের হাফেজ ছিলেন বলে তার আসল নামটি চাপা পড়ে ‘হাফিজ’ নামেই পরিচিতি লাভ করেন। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে শিরাজের মোসাল্লা নামক স্থানে চতুদর্শ শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বহু বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও কীর্তিমান ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান এই শিরাজ। এটি কবি ও সাহিত্যিকের শহর হিসেবে পরিচিত। তাই তো উইকিপিডিয়া বলছে, Shiraj is known as the city of poets, literature, wine (despite Iran being an Islamic republic since 1979) and flowers.তার কবিতা, গজল, রুবাইয়াতের ছত্রে ছত্রে কুরআনের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে, তাই তো তিনি নিজেই তার ব্যাপারে বলেছেন-হে হাফিজ, তোমার বক্ষে ধারণকৃত এ কুরআনের চেয়ে সুন্দর ও সুমিষ্ট বাণী আর কিছুই দেখি না। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ। তার মধ্যে ঐশী প্রেমের যে অস্তিত্ব তিনি অনুভব করেছেন, সেটাকে তিনি আল্লাহর বিশেষ তোহফা হিসাবেই বিবেচনা করেছেন। মহান আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ছাড়া কোনো ভালোবাসাই পূর্ণতা পায় না, আর এ কথা তিনি বলেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্নভাবে।
নারীর প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা তার কবিতায় ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। প্রেয়সীকে কাছে পাওয়ার জন্য তিনি বলছেন, ‘প্রাণ যদি মোর দেয় ফিরিয়ে সেই তুর্কি সওয়ার মনচোরা, একটি কালো তিলের লাগি বিলিয়ে দেব সমরখন্দ ও বোখরা’। তিনি হয়তো কোনো সুন্দরীর প্রেমে পড়েছিলেন, আদর করে নামও দিয়েছিলেন শাখ-ই-নবাৎ। কিন্তু কখনো তার কোনো লেখায় সে রমণীর পরিচয় জানা যায়নি। বাস্তবে এ ধরনের কেউ কি ছিলেন? নাকি পুরোটাই তার কল্পনার দোলাচল? তার বক্তব্য, ভাবনা, ঊপলব্ধি প্রকাশে তিনি এত বেশি রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার করেছেন, যা বুঝতে মনস্ক পাঠককেও অনেক মনোযোগী হতে হয়। তিনি বলেছেন- Am I a sinner or a saint, which one shall it be? Hafiz holds the secret of his own mystery.হাফিজের অনেক রুবাইয়াত, গজল, কবিতাই হারিয়ে গেছে, তার বন্ধু গুল আন্দামের সংগ্রহ করা কবিতাগুলোই Divan-e-Hafiz নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ইরানের জনগণের চিন্তার জগতে এত বেশি প্রভাব রেখে গেছেন যে, তার মৃত্যুর ৭০০ বছর পরও ইরানের প্রায় প্রতিটি ঘরে হাফিজের কবিতার বই সংরক্ষিত ও পঠিত হয়। ওরা তাকে ভালোবেসে শিরাজের ‘বুলবুলি’ বলে ডেকে থাকেন।উইকিপিডিয়া বলছে-হাফিজের মৃত্যুর ১০০ বছরের মধ্যেও তার কোনো জীবনী রচিত হয়নি, তাই তার জন্ম-মৃত্যুর দিনক্ষণ ও জীবনের অনেক ঘটনাই সাধারণের অগোচরে থেকে গেছে। তার পিতা বাহাউদ্দীন ইস্পাহানি নগরী থেকে ব্যবসা উপলক্ষে শিরাজে এসে বসবাস করতে থাকেন। পিতার মৃত্যুতে হাফিজ ও তার মা কঠিন আর্থিক সমস্যায় পড়েন। তাই ছোট বয়সেই তাকে রুটির দোকানে কাজ করে সংসার চালাতে হয়।হাফিজের সাহিত্যকর্মে ইসলামের ব্যাপক প্রভাব এবং শ্রদ্ধা, ভালোবাসা থাকার পরও মুত্যুর পর তার দাফন কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে মতবিরোধ তৈরি হয়। তার ধর্মচিন্তা নিয়েও মানুষজন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। তখন কতিপয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যস্থতায় সিদ্ধান্ত হয় যে, তার সব সাহিত্যকর্ম একত্রে জড়ো করে কেউ একজন তার রচনার যে কোনো একটি পৃষ্ঠা খুলবে এবং সে পৃষ্ঠার প্রথম দু’লাইন পড়ে তার ধর্ম চিন্তার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত আসবে তা মেনে নেওয়া হবে। এ পদ্ধতিতে যে পৃষ্ঠা খোলা হয় তার প্রথম দু’লাইন ছিল ‘হাফিজের এ শব হতে গো তুলো নাকো চরণ প্রভু, যদিও সে মগ্ন পাপে বেহেশতে সে যাবে তবু’। এরপর সব মতবিরোধ ভুলে তাকে এক আঙুর বাগানে দাফন করা হয়। হাফিজিয়া নামের সে স্থান এখন ইরানের জনগণের ভক্তির একটি স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ওই স্থান পরিদর্শনে আসেন। আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হাফিজ পাঠে মুগ্ধ ও তার দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তিনি সরাসরি ফার্সি ভাষা থেকে তার (হাফিজ) কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। তিনি যখন রুবাইয়াত-ই-হাফিজ অনুবাদ করছিলেন, তখন তার সন্তান মৃত্যু শয্যায়। তাই তো নজরুল বলেছেন-‘যে পথ দিয়ে আমার পুত্রের শবযান চলে গেল, সে পথ দিয়েই এলেন প্রিয়তম কবি হাফিজ’। কাজী নজরুল হাফিজের কাব্য অনুবাদে মুনশিয়ানার ছাপ রেখেছেন এবং এ অনুবাদ কর্ম সর্বমহলে প্রশংসিতও হয়েছে। তাই তো মনের অজান্তে সেসব কবিতার সুর গুনগুনিয়ে বাজতে থাকে, তেমনি একটি ছন্দ-‘হায় বধুয়া! দাও পেয়ালা ঢালো শারাব মধুক্ষরা/সহজ ছিল পথটি প্রেমের দেখছি এখন কাঁটা ভরা/ভেবেছিলাম ভোর বাতাসে কস্তুরী বাস আসবে ভেসে/ বধুর চিকন চিকুর হতে কলজে হলো ঘায়েল শেষে।’ তিনি হাফিজের প্রায় ৩০-৩৫টি গজল অনুবাদ করেছিলেন।
জোড়াসাকোঁর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সাংস্কৃতিক বিকাশেও পারস্যের কবি সাহিত্যিকদের অসম্ভব প্রভাব লক্ষ করা গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফারসি ভাষার ওপর অগাধ দখল ছিল। সুলতানি আমল থেকে শুরু করে ইংরেজদের এ উপমহাদেশে ক্ষমতা গ্রহণের পরও দীর্ঘদিন ফারসি ছিল এ অঞ্চলের দাপ্তরিক ভাষা। সে জন্য শিক্ষিত ব্যক্তি প্রায় সবাই কমবেশি ফারসি জানতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হাফিজের এমন সমঝদার ছিলেন যে, প্রতিদিন সূর্য উঠার সময় সূর্যের দিকে মুখ করে হাফিজের কবিতা আওড়াতেন। অনেকেই বলে থাকেন তার হাফিজ মুগ্ধতা ছিল তার উপনিষদ সাধনার মতো সত্য। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারস্য ভ্রমণে বাদ যায়নি সেসব কবিদের সমাধি পরিদর্শন। হাফিজের সমাধিতে এসে কবিগুরু বলছেন-‘আমার পিতা ছিলেন হাফিজের অনুরাগী ভক্ত, তার মুখ থেকে হাফিজের কবিতার আবৃত্তি ও তার অনুবাদ অনেক শুনেছি। সেসব কবিতার মাধুর্য দিয়েই পারস্যের হৃদয় আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। আমি সেসব কবিদের উদ্দেশে আমার সকৃতজ্ঞ অভিবাদন অর্পণ করতে চাই। যাদের কাব্য সুধা জীবন্তকাল পর্যন্ত আমার পিতাকে এত সান্ত্বনা, এত আনন্দ দিয়েছে।’ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী হাফিজের সমাধি পরিদর্শন করেছিলেন। এর অল্প কয়দিন আগে তার পায়ে সার্জারি হওয়ার কারণে তিনি ব্যথা অনুভব করছিলেন। গাইডরা তার মন ভালো করতে হাফিজের কবিতা সম্পর্কিত একটি স্থানীয় প্রবাদ শোনান-কেউ মনে কোনো গোপন ইচ্ছা নিয়ে হাফিজের কবিতার বইয়ের যে কোনো পৃষ্ঠা খুললে যে কবিতা দেখা যাবে তাতে সে ইচ্ছা সম্পর্কিত ইঙ্গিত পাওয়া যাবে, এবং হলোও তাই, এতে তিনি এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যে অনেকক্ষণ একা তার কবরের পাশে বসে নীরবে অশ্রুপাত করেন। বলা হয়ে থাকে মহারানি ভিক্টোরিয়া সমস্যা উত্তরণে কখনো কখনো হাফিজের লেখনির শরণাপন্ন হতেন। হাফিজ সাহিত্য কর্ম ইংরেজিতে প্রথম অনূদিত হয় ১৭৭১ সালে এবং তার আগে ইউরোপে হাফিজের কোনো পরিচিতি ছিল না বললেই চলে। উইলিয়াম জোনসের অনুবাদ পাশ্চাত্যের লেখক থোরো (Thoreau), গেটে, রালফ ওয়ালডো এমারসন-এর ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের অনন্য চরিত্র শার্লক হোমস হাফিজ সম্পর্কে বলছেন-. There is as much sense in Hafiz as in Horace, and as much knowledge of the world. হাফিজের প্রতি গেটের অসাধারণ শ্রদ্ধার কারণে হাফিজ জার্মান জনগণেরও ভালোবাসার ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তাই তো এ দু’ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনে গেটের জন্মস্থান ওয়েমার সিটিতে একটি মনুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। ওয়েমার জার্মানির একটি প্রাচীন শহর, শত শত বছর ধরে এটি জার্মানির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত। এখানে একটি গ্রানাইট প্রস্তরখণ্ড কেটে মুখোমুখি দুটি চেয়ার বানানো হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রখ্যাত দু’কবির আত্মিক ঘনিষ্ঠতাকে চিত্রিত করাসহ আরও বোঝানো হয়েছে, পৃথিবীর দু’প্রান্তের দু’বিখ্যাত কবি সামনাসামনি বসে পূর্ব পশ্চিম নিয়ে আলোচনা করছেন, যদিও দু’জনের এ পৃথিবীতে আসার সময় ও দু’দেশের ভৌগলিক দূরত্বের ব্যবধান যথাক্রমে শত বছর ও সহস্র মাইলের। ২০০০ সালে ইরান ও জার্মানি সরকারপ্রধান যৌথভাবে এ মনুমেন্টের উদ্বোধন করেন। আসলেই পূর্ব পশ্চিমের সভ্যতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সাংস্কৃতিক দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য সংলাপ, সদ্ভাব ও সুসম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই। এ দূরত্ব কমিয়ে আনতে ‘সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিনিময়’-এর আলোচনা শুরুর এই তো সময়, আর এ মনুমেন্ট সে ইঙ্গিতই দিয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর অক্টোবর মাসে ইরান ও জার্মানিতে ‘হাফিজ মেমোরিয়াল ডে’ উদযাপনের মাধ্যমে দু’কবির জন্মস্থান ওয়েমার ও শিরাজ নগরী যেন ‘টুইন সিটি’তে পরিণত হয়ে গেছে। হাফিজ তার জীবদ্দশাতেই ইসলামি বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিলেন, তখন থেকে ব্যাপক বিস্তৃত এ অঞ্চলের কবি, গীতিকার, সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। তার গান, কবিতা, গজল ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গীত ও পঠিত হয়ে থাকে। তিনি লেখনির সাহায্যে প্রায় সব জাতি, গোষ্ঠী, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানুষের কাছে পৌঁছে গেছেন। তাকে নিয়ে, তার সাহিত্যকর্ম ও দর্শন নিয়ে এখনো বিশ্ব সাহিত্যবোদ্ধারা গবেষণা করে চলেছেন। প্রখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দাসপ্রথা উচ্ছেদের অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব রালফ ওয়ালডো এমারসন (১৮০৩-১৮৮২) তাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলছেন-Hafiz is a poet of poets.
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, যুগান্তর পত্রিকা ও অন্তর্জাল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct