পানবিবি কালাচাঁদ ও হাবু
হেদায়েতুল্লাহ
এই যে শুনুন না--! সাঁজবেলায় দেখা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সাইকেল করে স্টেশান থেকে ফিরছে হাবু। এদিকটা নিরিবিলি। রাস্তার ডানদিকে বাঁশবন বাঁদিকে কবরস্থান। এখানে লোকে ভয় পায়। হাবুর গা’টা কেঁপে ওঠে। তবে ভয় পাওয়ার কি আছে? ডাকাবুকো নাহলেও ভীতু না। ব্রেক কষে সাইকেল দাঁড় করায়। তখন পাশের বাঁশবন থেকে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসে। চারদিকে বড়ো বড়ো গাছগাছালিতে ছমছমে আঁধার। সে এবার হাবুর সামনে এসে বলে,বড়ো বিপদে পড়েচি। ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হয়। আগে নারী কণ্ঠের আর্তি এবার অবয়ব। হাবু বিব্রত গলায় বলে,কে তুমি? আঁধার হলেও আন্দাজ করতে পারে,বয়েস তার বেশি না। মেয়েটা এবার বলে,আপনি আমাকে ঠিক চিনবেন না। সে না হয় হল কিন্তু বিপদটা কী?তাকে বাঁশবনে খুঁজচি। অসহায় গলা মেয়েটার।জঙ্গলে বিপদ জানো? কেউটে গোফরোর বাসা। কালাচাঁদকে হারানো তার চে’ বড়ো বিপদ আমার কাচে। তুমি এমন প্রলাপ বকচ কেন?আমার জায়গায় আপনি থাকলে এমন বকতেন। তা বুজলুম কিন্তু কালাচাঁদ কে?আর বলবেন না!সে এক মূর্তিমান আপদ। তবে তার খোঁজ করচ কেন?তাকে না পেলে বাড়ি ফিরতে পারব না। তোমার বাড়ি কোথায়? এ গাঁয়ে তো দেকিনি। হাবু যেন ঠিকুজি খুঁজতে চায়। এখানে বেশিদিন আসিনি। কোথায় এসেচ?মোল্লাপাড়ায়। মোমিন মামা হয়। হাবু চুপ করে ভাবতে থাকে। তারপর স্মৃতি হাতড়ে বলে,তোমার নাম মিনু না?আপনি কী করে জানলেন?মোমিনমিয়ার কয়েক বাড়ি পরে আমরা থাকি। কই আপনাকে তো দেকিনি। আমি দমদমের এক দোকানে কাজ করি আর এই ফিরি। এমন সময় বাঁশবনের দিক থেকে হুটোপাটির সঙ্গে ব্যা ব্যা শব্দ। তাদের সংলাপে ছেদ পড়ে। মোবাইলে আলো জ্বালার কথা মনে পড়ে এতক্ষণে। হাবু দেখে,মিশমিশে কালো একটা যেন ছোটখাটো ষাঁড়। আলো দেখে সে ছুটতে থাকে। কালাচাঁদকে হারানোর ভয়ে মিনু তার পেছন ধরে। মোবাইলের বাতি নিভিয়ে সাইকেলে উঠে হাবু। বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়েছে। হাবুর মা উচ্ছেবিবি যেমন খুশি হয়,তেমন গজগজ করে। ছোটছেলেকে নিয়ে তার এ বেলার সংসার। বয়েস হয়েছে। বাঁ হাঁটুতে বাত। উঠতে বসতে নাজেহাল। তাতে হাবুর রান্নাবা্ন্না আর গেরস্থালির কাজ! বাপ মা অবস্থা তার। লতু সতু আর হাবু তিন ভাই। বড়ো দু’জন আলাদা সংসার পেতেছে। মায়ের কথায় কান পাতে না সে। এইতো দিব্যি চলে যাচ্ছে। খামোকা অশান্তি ডেকে আনা কেন?বড়ো দু’ভাইকে সে দেখেছে। বিয়ের পর পর নানান অজুহাতে তারা আলাদা হয়েছে। সে সরে গেলে মাকে দেখবে কে?লতু সতু বলে,হাবু একটা বোকার হদ্দ। তা বলার হক তাদের আছে। বিএসসি পাশ করার পর চাকরির পরীক্ষা দেয়। তারপর দলের ছেলেদের সঙ্গে ঘুরতে থাকে। সঙ্গীরা সব গুছিয়ে নিল। আর সে তর্ক বাধিয়ে এক কেলেংকারি!তোলাবাজ সঙ্গীদের হাতে মারধোর খেয়ে বিছানা সই। এসব কীসের লক্ষণ! তাদের এক দূর সম্পর্কের মামা থাকে কৈখালি। হাবু যাতে বয়ে না যায় সেজন্যে একটা কাজ জোগাড় করে দিল। দমদমের এক হোলসেল ওষুধের দোকানে হিসেব রক্ষকের কাজ। রাতেরবেলা টিনের চালের ফাঁক দিয়ে জোছনা ঘরের ভেতর। উঠোন থেকে কামিনিফুলের গন্ধ তীব্র হয়। ঠিকমতো ঘুম আসে না। সে আধোঘুমে থাকে। যেন এক বিভ্রমে পড়ে যায়। কোনটা ঠিক,মিনু না পানবিবি,পানবিবি না মিনু?সারা সপ্তা কাজে কেটে যায়। বন্ধুবান্ধব সব বাদ হয়ে গেছে। রোববার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ির পেছনে ছোট ডোবার পাশে বসে। গুটি গুটি পায়ে ফরিদ এসে জোটে। তারা দুজনে বড়ো হিমসাগর আমগাছের আড়ালে বসে। মিরপাড়ার ফরিদ একমাত্র বন্ধু হিসেবে টিঁকে গেছে। এদিকে সচরাচর কেউ আসে না। ফরিদ প্যান্টের পকেট থেকে ছিলিম বের করে। কলকেয় টান দিতে মেজাজ শরিফ হয়। হাবু বলে,বুজলি ফরিদ,কালকে ফেরার পথে এক জব্বর কাণ্ড! সে আবার কী?পানবিবিকে দেকলুম। পানবিবি—? পানবিবি--?কিছুখন চুপ করে মনে করার চেষ্টা করে ফরিদ। তার অবস্থা দেখে হাবু বলে,সেই ছোটবেলার কথা। ভুলে গেলি নাকি?বুজেচি--! তারপর লম্বা এক টান মেরে ফরিদ বলে,এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আচে?কেন?ওর বড়ো পোড়া কপাল। মা ডেঙ্গুতে মারা গেচে। বাপ হারামি চল্লিশদিন পার হতে না হতে নিকে করেচে। তারপর?তারপর আর কী?যা হওয়ার তাই হয়েচে। ভেঙ্গে বল গুরু। ফরিদ চুপ করে থাকে। হাবুর সঙ্গে ছোটবেলা থেকে দোস্তি। হেন কোন ব্যাপার নেই দুজনের আলোচনা হয় না বা জানে না। সে ধীর গলায় বলে,সৎমা তো এক খাণ্ডারনি। সতীনের অতবড় মেয়ে! তার আর সহ্য হয়। তুই এতকথা জানলি কী করে? সন্দেহের চোখে তাকায় হাবু। আমি তোর মতো ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? তাছাড়া সে আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাহলে মামার বাড়ি এসে বেঁচেচে। তা যা বলেচিস!ফুটন্ত তেলের কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে। মোমিনের বৌকে চিনিস তো! চুপ করে যায় হাবু। তার মনে অনেক কথার উদয় হয়। পুরোনো স্মৃতি যে এভাবে কালকে সাঁজের আঁধার আচমকা ফিরে আসবে তা কে ভেবেছে? বিভ্রম কেটে গেছে তার। হাসিমুখো মিনু যে পানবিবি তাতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও কালকের আঁধারে সবকিছু টের পায়নি। হঠাৎ সে ফরিদের হাতদুটো জড়িয়ে ধরে,তোকে একটা কথা রাখতে হবেই। সাধ্যের মধ্যে হলে হবে। তুই মিনুর ফোন নাম্বারটা এনে দিতি পারিস?বললি বটে! কেন?কালোবিবি যাকে দুবেলা খাওয়ার খোঁটা দেয়,তার কাচে থাকবে মোবাইল! দুজনে গাঁজা টানা শেষ করে চুপচাপ বসে থাকে। মিনু সেদিন কী বলল জানিস?হঠাৎ মুখ খোলে ফরিদ। কী?আমার দোকানে মাঝে মাঝে মাল কিনতি আসে। বলে,ফরিদভাই!তোর দোকান থেকে বিষ দিতি পারিস,প্রাণডা জুড়াই। আকাশের দিকে তাকায়। সিঁদুরে রঙ ধরেছে পশ্চিম আকাশ। উঠে পড়ে ফরিদ। চললি নাকি? হাবু বলে। তোর তো ছুটি কিন্তু আমাকে দোকান খুলতে হবে। বিকেলের দিকে ঘর-ফেরতা কিছু খদ্দের লাগে। ঠিক আচে। একটা কাজ করে দিতি হবে। কী কাজ?রাতেরবেলা দোকান বন্ধ করে যাওয়ার সময় একবার দেখা করিস। বুধবার সাঁজেরবেলা কালাচাঁদকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? এযে রাত নামতে চলল। আর দেরি করলে মামি পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙবে। তার কপাল বুঝি এমন? চিঠি লিখেও সে এলো না যে! কবরের দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। দাঁড়াতে আর সাহস হয় না। চারিদিকে যেন ভয়। বিমর্ষ মুখে কালাচাঁদকে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় মিনু।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct