অলৌকিক
হাবিবুর রহমান
অভিজ্ঞতার ভান্ডার পরিপূর্ণ। বরাবর থানায় চাকরি করেছি। কত ঘাত প্রতিঘাতের সাক্ষী আমি।একটা থানায় ওসি থাকাকালীন অফিস চেম্বারে কাজ করছি।সেন্ট্রি ভেতরে ঢুকে স্যালুট করে বললে, স্যার একটা ছেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।আমি সম্মতি দিয়ে তাকে বললাম, পাঠাও ভেতরে।ছেলেটি ভেতরে ঢুকলো। চোখে চশমা, অতি সাধারণ ময়লা পাজামা পাঞ্জাবি, পায়ে হাওয়াই চপ্পল।কুণ্ঠিতভাবে সে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, চেয়ারে বসো। সে লজ্জিত ভাবে বলল, না সাহেব, আমি দাঁড়িয়েই বলি।আমি বললাম, আরে না না,তুমি চেয়ারেই বসো।অতিশয় জড়োসড় ভাবে সে চেয়ারে বসলো।আমি তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার সমস্যার কথা বল।সে নীরবে তার চশমাটা খুললো। একটা চোখ অন্ধ।তারপর কাতরস্বরে বললো, সাহেব গরিবের ঘরে জন্মেছি, অ্যাক্সিডেন্টে একটা চোখও খুইয়েছি। এই একটা চোখেই দুনিয়া দেখি....তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার মত অনেকেই এক চোখে দুনিয়া দেখছে। তাতে কি হল। আমার কাছে কেন এসেছো বলো?সে ছর ছরিয়ে কেঁদে ফেলল, সাহেব,এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছি। কষ্টের সংসার, নাম্বার ভালো আছে। কলেজে আমার ভর্তি হওয়ার টাকা নাই হুজুর।বাপে মায়ে ফেরি করতে বলছে। আপনি যদি একটু দয়া করেন, কলেজে ভর্তি হতে পারি।তার অবস্থা দেখে মায়া হল। তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, যাও তোমার কলেজে ভর্তির টাকা আমি দেব।ছেলেটা আমার পা ছুয়ে নমস্কার করল।থানার ব্যস্ততা,প্রচুর কাজ। মাঝে মাঝে ছেলেটি আসে। আমি তাকে সাহায্য করি। আর বলি, এ কথা কাউকে জানিও না ।সে মাথা নেড়ে সায় দেয়। একদিন এসে খুশি হয়ে জানান দেয়, সাহেব, আমার পড়াশোনা ভালই হচ্ছে, এই দেখুন আমার পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট।দেখে চমকে উঠলাম, ৭০% নাম্বার পেয়েছে ছেলেটা।
তার পিঠ চাপড়ে সাবাসি দিলাম, আর বললাম,মন দিয়ে পড়াশোনা কর।ছেলেটি কৃতজ্ঞচিত্তে নমস্কার করে চলে যায়।বদলির চাকরি,পাশের থানায় ওসি হলাম। সেখানেও সে আমার সঙ্গে দেখা করলো।আমি তাকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, পড়ে যাও, আমি আছি তোমার পেছনে। সময় গড়িয়ে চলেছে। আমি আমার কাজে ব্যস্ত।ছেলেটি ভালো নাম্বার নিয়ে বিএ পাশ করলো।আমার সাথে দেখা করলে আমি ছেলেটিকে এমএ তে ভর্তি হতে বললাম।সে কেঁদে ফেললে, হুজুর বাড়ির লোক চায় না আমি আর পড়ি । এখন আমি তাদের কাছে বোঝা ঠেকছি স্যার।ছেলেটির অবস্থা দেখে আমার মায়া হল।আমি তাকে পরামর্শ দিলাম, আমি আছি, তুমি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চাকরির পরীক্ষা দাও। দেখবে কিছু না কিছু পেয়ে যাবে।কৃতজ্ঞতায় ছেলেটার চোখে জল এলো।পুলিশের চাকরি।আবার বদলি, এবার দ্বীপান্তরে দূরের থানায়। ছেলেটার সাথে যোগাযোগ আর হয়না।তবে চিঠিতে সে আমাকে জানিয়েছিল, সাহেব, ক্লারিক্যাল পোস্টে চাকরি পেয়েছি।ব্যাস ওই পর্যন্ত। আস্তে আস্তে সম্পর্ক ফিকে হয়ে গেল। পুলিশের চাকরি। এবার জেলা বদলি। ছেলেটার খবর আর রাখিনা।দেখতে দেখতে অবসর নিলাম। ফ্যামিলি ট্যুরে সুন্দরবন। তখন মাতলা নদীতে ব্রিজ হয়নি। পুলিশ ডক ঘাট ব্যারিকেট করেছে। বি ডিও সাহেব যাওয়ার পরে তবেই প্যাসেঞ্জার যাবে। আমরা ঘাটের সামনের বেঞ্চে বসে পড়লাম। বি ডিও সাহেব গাড়ি থেকে নামলেন। হেঁটে হেঁটে ঘাটের দিকে যাচ্ছেন।কিছুক্ষণ পরে হইচই পড়ে গেল। সাহেব এদিকেই আসছেন। সবাই টতস্থ, দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও দাঁড়িয়ে। বি ডিওসাহেব অতো লোকের সামনে আমার পায়ে এসে নমস্কার করলেন। আমি তো অপ্রস্তুত। সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, স্যার কেমন আছেন? আমি ভ্যাকাচেকা খেয়ে গেলাম। তিনি শুধালেন, কোথায় ছিলেন এতদিন? আপনার সাথে দেখা করার জন্য আমি জনে জনে খোঁজ নিয়েছি, কেউ আপনার কোন ঠিকানা দিতে পারেনি। আমি স্যার এখন এখানকার বিডিও হয়েছি। এবার চিনতে পেরে তার পিঠ চাপড়ে বললাম,সাবাস! তুমিতো মিরাকেল ঘটিয়েছ। কেমন করে সম্ভব হল? সে বললে, সাহেব, আপনি তো জানতেন আমি ক্ল্যারিকালে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু হাল আমি ছাড়িনি স্যার। পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি, মিসলেনিয়াস পরীক্ষায় বসে ইউ ডি ক্লার্ক হয়েছি স্যার। তারপরে আস্তে আস্তে চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে। ভিড়ে লোকজনে মেলা লেগে গেছে। বি ডিও সাহেব কেঁদে ফেললেন , স্যার,বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আপনি আমার আসল বাবার কাজ করেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না. আপনি আমার অন্তরের দেবতা। আপনাকে প্রণাম। তার কথা শুনে আমার চোখে আনন্দ অশ্রু।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct