রাজ্যের অন্যতম পিছিয়ে পড়া মুর্শিদাবাদের জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে উঠে এসে বিশ্বের ২ শতাংশ শীর্ষ বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম স্থান করে নিয়েছেন ড. তরিকুল ইসলাম। দু দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপনা করে চলেছেন। কিন্তু তার মনপ্রাণ সব সময় পড়ে থাকে জন্মভূমি তথা বাংলার জন্য। কীভাবে মূলত বাংলার সংখ্যালঘুদের উচ্চ শিক্ষার শিখরে নিয়ে যাওয়া যায় তা নিয়েও রয়েছে তার ভাবনা। তাকে নিয়ে লিখেছেন জাইদুল হক...
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ২০২১ সালে বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর এক তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকায় দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ২১ জন গবেষক-অধ্যাপক অন্তর্ভুক্ত হন। আর এই ২১ জনের তালিকায় অন্যতম স্থান করে নেন মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র ড. তরিকুল ইসলাম। প্রখ্যাত স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন আইওনিডিসের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞদের একটি দল বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ বিজ্ঞাীর তালিকাটি তৈরি করে এবং তাএলসেভিয়ার বিভি প্রকাশ করে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বিশ্বের এক লাখেরও বেশি শীর্ষ বিজ্ঞানীর সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ ডাটাবেস বিভিন্ন লেখকের অবস্থান এবং একটি কম্পোজিট সূচকের কাগজপত্রে উদ্ধৃতি, এইচ-ইনডেক্স এবং উদ্ধৃতি সম্পর্কিত মানসম্মত তথ্য সরবরাহ করে ২২ টি বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র এবং ১৭৬ টি উপ-ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করে তারপর নির্বাচিত করা হয় বিজ্ঞানীদের। তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি তালিকায় ভারতের মোট ৩,৩৫২ জন গবেষকের নাম ছিল, যার মধ্যে ছিল শুধু জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ২১জন। আর সেই তালিকায় এক উজ্জ্বল নাম মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র ড. তরিকুল ইসলাম। দেশের অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া মিলিয়া ইসলিামিয়ায় দুদশকেরও বেশি সময় ধরে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপনায় নিযুক্ত রয়েছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তার মুকুটে স্থান পেয়েছে বহু সম্মান। আন্তর্জাতিক নানা জার্নালে প্রকাশিত হয়ে তার বহু গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ। এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এই ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক-বিজ্ঞানীর জীবন আদর্শ হয়ে উঠতে পারে এ রাজ্যের শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের। তরিকুল ইসলাম মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা থানার শিবতলা গ্রামে নয় ভাই-বোনের এক বড় পরিবারে কনিষ্ঠ পুত্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। আশির দশকে গ্রামে যাওয়ার রাস্তা ছিল মার্টির। বর্ষা এলেই কর্দমাক্ত রাস্তাতেই যাতায়াত করতে হত। পরিবহন এবং বিদ্যুতের মতো মৌলিক সুবিধাগুলি থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত ছিল গ্রামটি। গ্রামের একপাশে বাগমারি নামে একটি নদী এবং অন্যদিকে ভাগীরথী নদী নামে গঙ্গা নদী রয়েছে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই ছিল দরিদ্র। বিড়ি বাঁধাই ছিল গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা এবং শৈশব কেটেছে বিড়ি শ্রমিকদের সন্তানদের সঙ্গে খেলে। সেই দিনগুলিতে মোটরযান পেতে রেললাইন অতিক্রম করে কমপক্ষে ৩-৪ কিলোমিটার হাঁটতে হত। গ্রীষ্মকালে বাঁশ ব্রিজের উপর বাগমারী নদী পার হয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ কিলোমিটার (৩ ঘণ্টা আসা-যাওয়া) পায়ে হেঁটে, আর বর্ষাকালে নৌকায় পার হয়ে স্কুলে যেতে হতো।
তরিকুল ইসলাম তার শৈশবের স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘আমার মনে আছে বর্ষাকালে একদিন যখন নদীর জল বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। ফেরির নৌকা চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছিল। তখন আমাকে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিতে আমার বাবার সাথে গঙ্গা নদীর মধ্য দিয়ে নৌকায় করে স্কুলে যেতে হয়েছিল। সেসময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না, তাই কেরোসিন বাতি ছিল রাতে পড়াশোনার জন্য আলোর উৎস মাত্র। প্রথম দিকে জীবন এত সহজ ছিল না। একটি বড় পরিবারের কারণে, তার বাবা-মাকে দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অনেক সময় পুরনো বইগুলো ব্যবহার করতে হতো। একবার তরিকুল যখন তার বাবাকে অষ্টম শ্রেণিতে ঘড়ি পেতে বলেছিলাম, তিনি বলেছিলেন, যদি বোর্ড পরীক্ষায় স্কুলে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করো তাহলে তুমি ঘড়ি পেতে পারো। যদিও এক শিক্ষক পরিবারেই তরিকুল ইসলামের জন্ম। তার বাবা, মামা এবং দাদা সকলেই মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের কাঞ্চনতলা জেডিজে ইনস্টিটিউশনের স্কুল শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষা ছিল তার পরিবারে প্রাথমিক গুরুত্ব এবং তার বাবা-মা সবসময় তাদরেকে শিক্ষায় সেরাটা দেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তারই উচ্চশিক্ষার জন্য তার অনুপ্রেরণার প্রাথমিক উৎস বলে জানান তরিকুল ইসলাম। তরিকুল ইসলাম মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা থানা এলাকার মহেশপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৮৭ সালে কাঞ্চনতলা জে.ডি.জে ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সবসময় স্কুল পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন তরিকুল। বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর ১৯৯৪ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হন। তারপর আলিগড় থেকেই ইনস্ট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমে এমটেক সম্পন্ন করেন।গ্রামের ছেলে আলিগড়ে গিয়ে পড়াশুনায় জীবন অত সহজ ছিল না। খাদ্য, ভাষা এবং পরিবেশ সহ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন। এএমইউতে সন্ধ্যায় টিফিন খাওয়ার জন্য খুব কমই টাকা থাকত। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার মধ্যে শিক্ষকতায় গবেষণায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার জোরদার হয়ে ওঠে।। তাই ১৯৯৮ সালে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেনি। এরপর ২০০৭ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি হাসিল করেন। তিনি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য এআইসিটিই থেকে জাতীয় ফেলোশিপ পেয়েছিলেন।১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামিয়ার সহকারী অধ্যাপক এবং ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে ছিলেন। ২০১২ সাল থেকে এখনও একই পদে আছেন।
তরিকুল ইসলাম পারমাণবিক শক্তি বিভাগ (ডিএই), পারমাণবিক বিজ্ঞান গবেষণা বোর্ড (বিআরএনএস), মুম্বাই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ (ডিএসটি), ভারত সরকার, প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও), সেন্ট্রাল পাওয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপিআরআই বেঙ্গালুরু), বিদ্যুৎ মন্ত্রক, মানবসম্পদ ও উন্নয়ন মন্ত্রক (এমএইচআরডি) সহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে গবেষণা তহবিল পেয়েছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে প্রায় ২০জন শিক্ষার্থী পিএইচডি সম্পন্ন করেছে ও এখনও পিএইচডির জন্য নিবন্ধিত করছে। ইনস্টিটিউট ফিজিক্স ইউকে, স্প্রিংগার নেচার সুইজারল্যান্ড, এলসেভিয়ার, আমেরিকান বৈজ্ঞানিক প্রকাশকদের দ্বারা প্রকাশিত বইয়ের ১০টি অধ্যায়ে লিখেছেন। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সম্মেলনে ৮০টিরও বেশি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন ২৫টিরও বেশি কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। তার গবেষণার বিষয়গুলির মধ্যে সেন্সিং প্রযুক্তি এবং ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিন ‘আইইইই সেন্সর জার্নাল’-এর টপিকাল সম্পাদক, আইইইই ট্রানজেকশনস অন ইনস্ট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড মেজারমেন্ট (টিআইএম) এর সহযোগী সম্পাদক হিসাবে নিযুক্ত হন। আইইইই সেন্সর জার্নাল সেন্সিং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অন্যতম সেরা জার্নাল এবং আইইইই টিআইএম ইনস্ট্রুমেন্টেশন ও পরিমাপের জন্য সেরা জার্নালগুলির মধ্যে একটি। আইইইই সেন্সর কাউন্সিল তাকে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে আইইইই সেন্সর জার্নালের সেরা পারফর্মিং সহযোগী সম্পাদক, ২০২১ সালে আইইইই ট্রান্স অন ইনস্ট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড মেজারমেন্টের অসামান্য সহযোগী সম্পাদক হিসাবে পুরস্কৃত করেছিল। তারই সুবাদে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির শীর্ষ ২% বিজ্ঞানীদের বিশ্ব তালিকায় স্থান করে নিতে পেরেছিলেন।তরিকুল ইসলাম অধ্যাপনার জীবনকালের শুরু থেকেই পুরোটা কাটাচ্ছেন রাজধানী দিল্লিতে। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় অধ্যাপনার শুরু আর সেখানেই তিনি স্বমহিমায় শিক্সার্থীদের ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা িদয়ে চলেছেন। পরিবার নিয়ে দিল্লিই এখন তার বাসস্থান হলেও ভাড়া বাড়িতেই থাকেন। মনপ্রাণ পড়ে রয়েছে নিজের রাজ্যে, নিরে জন্মভূমির দিকে। দিল্লিতে তার সঙ্গে আলাপকালে তার মাটির টানের কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি রাজ্যের কোনও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী কিনা জিজ্ঞেস করলে জানিয়েছিলেন, সবারই তো নিজেরে রাজ্যের প্রতি টান থাকে। তিনিও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি জানান, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া পরিকাঠামো অত্যন্ত আধুনিক ও উন্নত। এ ধরনের পরিকাঠামো ও উন্নয়নের সুযোগ পেলে পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ও সেই মানে পৌঁছতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি আলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তুললে তিনি বলেন, একদিকে যেমন উপযুক্ত স্থায়ী উপাচার্য প্রয়োজন, তেমনি পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আর্থিক সহায়তাও জরুরি। আলিয়ার অচলাবস্থার কথা শুনে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। তার প্রশ্ন সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জামিয়া যদি দেশের কাছে উজ্জ্বল হয়ে থাকে আলিয়া পারবে না কেন। অযাচিতভাবে তার কাছে জানতে চাই, বাংলার সন্তান হিসেবে তার কাছে আলিয়ার স্থায়ী উপাচার্যের প্রস্তাব এলে তিনি তা গ্রহণ করবেন কিনা। সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রস্তাব এলে তখন ভেবে দেখা যেতে পারে। সেই সঙ্গে তিনি অকপটে জানান, অবসরের পর বাংলায় ফিরে যেতে হবে। আর তা জন্মভূমির টানে। তবে দিল্লিতে থাকলেও তিনি চান মুর্শিদাবাদ সহ রাজ্যের সংখ্যালঘুরাও উচ্চশিক্ষায় বিশেষ নজির সৃষ্টি করুক। আর সেই কাজে তিনি সর্বদা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চান।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct