মহবুবুর রহমান: ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এক বলিষ্ঠ বৈশিষ্যসূচক প্রতিরোধশক্তি ও জাত-পাত নির্বিশেষে ঐক্যতানের প্রবহণ। কিন্তু গণতান্ত্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে এই অভিন্ন দেওয়ানী বিধি (UCC) এক অশুভ সংকেত বৈকি কিছু নয়। যা ভারতবর্ষের গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র্যের ভাবমূর্তিকে সমূলে হত্যা করবে। আমরা জানি ভারত স্বাধীনতার প্রাক্কালে সবচেয়ে গুরুতর যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, সেটাই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। কারণ এখানে শুধু এক ধর্ম, এক জাত, এক সংস্কৃতি বসবাস করত না। বরং এখনকার মতোই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-কৃষ্টি-কালচার নির্বিশেষে সবাই নিজ ভাবমূর্তিকে নিয়ে বসবাস করত। সেখানে আবার একত্বতা ভালো দিক নির্দেশ করে না। স্বাধীনতা প্রাপ্তির কাছাকাছিতে একবার জওহরলাল নেহেরুকে যখন আলবার্ট আইনস্টাইন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি সবচেয়ে কঠিন কাজটি কী করেছিলেন, তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “একটি ধর্মীয় সমাজে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলা “। ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখার জন্য তিনি বিভিন্ন কারণ ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হওয়া উচিত যেখানে সমস্ত নাগরিককে সমান ভাবে বিবেচনা করা হবে যাতে তারা নিজেদের ভাব, ভাষা,ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে স্বমহিমায় আদান-প্রদান করতে পারবে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রত্যকের নিজ সংস্কৃতির প্রকৃতি ভারতকে সমাজতান্ত্রিক, সমতা, স্বাধীনতা এবং ভ্রাতৃত্বের লক্ষ্য ও নীতিগুলি উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে। রক্তে রঞ্জিত হয়ে যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রাণকে বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেন’নি তারাও সেই সময় বৈচিত্র্যের ভাবকে স্যালুট জানিয়ে বিশ্বদরবারে ভারতের শান-মানকে আরও বিস্তৃত করেছিলেন। তাইতো ভারতীয় মহৎ সংবিধান ভারতের প্রতিটি ধর্মের মানুষ কে নিজ ধর্মীয় আইনানুযায়ী খাওয়া দাওয়া,জীবন যাপন, ধর্মীয় সাজপোশাক ধারণ,কৃষ্টি কালচারাদি লালন পালনের পূর্ণ অধিকার দিয়েছে।সকলে নিজ নিজ ধর্ম পালন,প্রচার প্রসার করতে পারবে।এতে বাধ সাধার কারো বিন্দু পরিমাণ এক্তিয়ার নেই। তাই ভারতের মতো ধর্মীয় আদি বৈচিত্রপূর্ণ দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত সমদেওয়ানী বিধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্মাচারণের অধিকারের কথা বলা রয়েছে। শুধুমাত্র সংখ্যার জোরে, মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা দিতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের উপর জোর করে বিধি চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ সেই সংবিধান এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের মূলে আঘাত করা। সমগ্র ধর্মগোষ্ঠীর জন্য এক বিশেষ বিধান দেশের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে। আমাদের সার্বভৌম ভারতবর্ষ একটা গণতান্ত্রিক ও আধ্যাত্মিক দেশ। এখানে হিন্দু, মুসলিম,শিখ,ঈসায়ী সহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস। আমরা সকল ধর্মাবলম্বী মানুষ নিজেদের ধর্মীয় সংস্কৃতি ও রীতিনীতি মেনে চলে আসছি যুগ যুগ ধরে।দেশের সমূহ ধর্মাবলম্বী মানুষের নিজস্ব ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন রয়েছে,, সংবিধান আমাদের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন মেনে চলার পূর্ণ ছাড়পত্র দিয়েছে। তাই সংবিধান স্বীকৃত সর্বধর্মীয় আইনের ছাড়পত্র ও বৈধতাকে ফেলনা করে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের নান্দনিকতা কে থোড়াই কেয়ার করে অনাকাঙ্ক্ষিত ও জোরপূর্বক অভিন্ন দেওয়ানী বিধি লাঘুকরণ প্রস্তাবকে মানতে ভারতীয় সুশীল সমাজ একান্তই নারাজ। একজন দায়িত্বশীল ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ভারতীয় সংবিধানে প্রতি গভীর আনুগত্য, বিশ্বাস এবং সম্মানের সহিত গণতান্ত্রিক ধারাক্রমে ভারতীয় আইন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যাতে এই আইনকে (সমদেওয়ানী বিধি/UCC) প্রত্যাখ্যান করা হয়। ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা (২৫-২৮ অনুযায়ী) নিয়ে প্রত্যেককে স্বচ্ছন্দে বাঁচতে দেওয়া হোক। ভারতীয় আইন কমিশন এ বিষয় মূল্যায়ন পূর্বক যথার্থ পদক্ষেপ নিয়ে বাধিত করবেন, আশাবাদী।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct