আপনজন: গণমাধ্যমে বহুলালোচিত নাম আজহারউদ্দিন খান, তিনি বর্তমানে মালদহে ডিএসপি (ডিএনটি) পদে কর্মরত। অতি সম্প্রতি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মালদহে দেব বল্লভ নামে এক বন্দুকবাজকে পাকড়াও করে শিরোনামে উঠে আসা এই উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মীর সাহসী পদক্ষেপ কারোরই অজানা নেই। আল-আমীন মিশনের প্রাক্তনী আজহারউদ্দিনের কাজ এবং বুদ্ধিমত্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ গোটা বাংলা। সকলেই যেমন তাঁর বুদ্ধির প্রশংসা করছেন তেমনি তাঁর কাজেরও। নায়ক আজহারউদ্দিন, সুপারম্যান, সুপারস্টার, রিয়েল হিরো, উদ্ধারকর্তা ছাড়াও আরও কতো কী নামে অভিহিত হচ্ছেন তিনি। উল্লেখ্য, বুধবার পুরাতন মালদহের মুচিয়া চন্দ্রমোহন হাইস্কুলে বন্দুকবাজের হামলা ঘটে। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে স্কুলের ক্লাসরুমের মধ্যে ঢুকে পড়ে বন্দুকবাজ দেব বল্লভ। ওই ব্যক্তির কাছে একাধিক বন্দুক ছাড়াও অ্যাসিড বোমা এমনকি পায়ে ছুরিও বাঁধা ছিল। অস্ত্র হাতে শিক্ষার্থীদের রীতিমতো ভয় দেখিয়ে ‘পণবন্দি’র মত করে রাখে! বন্দুক উঁচিয়ে শাসানি দিতে থাকে ওই ব্যক্তি। খবর পেয়েই ছুটে আসে পুলিস। এরপরই ওই বন্দুকবাজকে কোনও সুযোগ না দিয়েই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ডিএসপি আজহারউদ্দিন খান ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই বন্দুকবাজকে কাবু করে ফেলেন। পরিকল্পনা মত তাকে সাহায্য করেন অন্য পুলিসকর্মীরাও। মুক্ত করা হয় কার্যত বন্দি হয়ে থাকা পড়ুয়াদের। ওই ঘটনায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেন এবং পড়ুয়াদের অক্ষত উদ্ধারের জন্য পুলিশকে ধন্যবাদ জানান। মালদহের স্কুলে বন্দুকবাজের হামলার ঘটনায় উদ্ধারকর্তা ‘হিরো’ আজহারউদ্দিন খান যদিও নিজেকে একাজের জন্য এতটুকু কৃতিত্ব দিতে রাজি নন। তাঁর কথায় ‘মাই নেম ইজ আজহারউদ্দিন খান, আই অ্যাম পুলিশ, দিস ইজ মাই ডিউটি।’ মালদহে ডিএসপি (ডিএনটি) পদে কর্মরত আজহারউদ্দিন খান একাধিক বিষয় নিয়ে দৈনিক ‘আপনজন’-এ একান্ত সাক্ষাৎকারে অকপট মন্তব্য করেছেন।
আজহারউদ্দিন খান থেকে ডিএসপি (ডিএনটি) আজহারউদ্দিন খান হয়ে ওঠার গল্পটা যদি শোনাতেন ? জন্মসূত্রে আমি কলকাতার বাসিন্দা, ১৯৮৫-র ৩১ জুলাই জন্ম। কলকাতাতেই পড়াশোনা, ২০০৪ সালে মাধ্যমিক, ২০০৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক, ২০০৭ সালে অনার্স নিয়ে বিএসসি স্নাতক পাশ করি। জীবনে সরকারি চাকরি করাবার ইচ্ছে ছিল না। বরাবরই, ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত একটি বেসরকারি কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে কাজ করেছি। তবে সেবছরই আমার বড়ো দাদা আব্দুল আজিমের অনুরোধে এবং দাদার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করি আল-আমীন মিশন থেকে, এরপর ২০১৩ সালে প্রথম ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় বসি, প্রথম বারেই ডব্লিউবিসিএসের সমস্ত ধাপেই সফল হয়েছিলাম, চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হয় ২০১৫ সালে। পরের বছর ডব্লিউবিসিএস গ্রুপ বি পদে কাজে যোগ দিয়েছিলাম। ট্রেনিং শেষে প্রথম পোস্টিং হয় জলগাঁওয়ের এসডিপিও হিসেবে। তারপরই আলিপুরদুয়ারের ডিএসপি ক্রাইম। ২০২০-তে ডিএসপি (ডিএনটি) মালদায় পোস্টিং হয়। পরিবারে কে কে আছেন? স্ত্রী, বাবা, মা। আছেন দাদা, বৌদিও। আমার দাদা আব্দুল আজিম টিসিএসে কর্মরত। দাদাও আল-আমীন মিশনের ছাত্র। আপনার সাফল্যের ক্ষেত্রে কাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ? সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখা দাদা এবং পরিবারের অনুপ্রেরণায়, পাশাপাশি ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য বিশেষ ভূমিকা রয়েছে আল-আমীন মিশনের, সে সময় আল-আমীন মিশনে একটা কোর্স শুরু হয়েছিল, আমরা তিন জন বন্ধু বসির মন্ডল, মোহাম্মদ আজাহারউদ্দিন, এবং আমি প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। আল-আমীন মিশনের সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম স্যারের তত্ত্বাবধানে মিশন কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছিলাম। যেভাবে নুরুল ইসলাম স্যার দিশা দেখিয়েছেন অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন তা কখনো ভুলবো না। বর্তমানে মোহাম্মদ আজাহারউদ্দিন রেভিনিউ অফিসার পদে, বসির মন্ডল এডিএসআর এবং আমি ডিএসপি পদে কর্মরত।
সরকারি চাকরি করাবার ইচ্ছে না থাকার সত্বেও বর্তমানে আপনি ডিএসপি (ডিএনটি) কেমন লাগছে? যখন ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য আমার দাদা প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলে তখন আমি জানতে চেয়েছিলাম এই চাকরির মাধ্যমে মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে কিনা, ইতিবাচক উত্তর পেয়ে প্রস্তুতি শুরু করি এবং পরবর্তীতে সফল হই এটা অত্যন্ত ভালোলাগার। তবে পুলিশ সম্পর্কে অনেকরই ভুল ধারণা রয়েছে, অনেকেই বলে বেড়ায় পুলিশ ঘুষখোর, পুলিশ চোর, পুলিশ জাল, পুলিশ মানেই দু-নম্বর ইত্যাদি। আমি যখন চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে আমার এক বন্ধুর বাবা কলকাতা পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিক রহমানি স্যারের কাছে যাই, এবং জানতে চাই পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়া ঠিক হবে কিনা। তখন উনি বলেন, ‘পুলিশের চাকরিতে দুটি পথ আছে, হয় তুমি জাহান্নামে যাবে না হলে তুমি জান্নাতে যাবে, এই চাকরি এমন একটি চাকরি যেখানে তুমি প্রচুর মানুষের সরাসরি উপকার করতে পারবে যারা তোমার জন্য সারা জীবন দু-হাত ভরে দোয়া করবে, আরেকটি পথ হল অসৎ পথ। এখন তোমাকে ঠিক করতে হবে তুমি কোন পথে যাবে।’ তাই প্রতিনিয়ত মানুষের জন্য সমাজের কল্যাণে কাজ করবার চেষ্টা করছি। পুলিশ হিসাবে এটাই আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য। নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জব্দ করলেন বন্দুকবাজকে, রক্ষা করলেন ৭১ জন শিক্ষার্থীর জীবন। কেমন লাগছে? আমি আমার ডিউটি পালন করেছি মাত্র। আমার প্রাণের চেয়ে বাচ্চাদের প্রাণ অনেক মূল্যবান। এতগুলো বাচ্চার যদি কিছু হয়ে যেত, তা হলে পুলিশ হয়ে মানুষকে জবাব দিতে পারতাম না। কীভাবে করলেন এই অসাধ্যসাধন ? আমার এসপি স্যারের থেকে ওই স্কুলের ঘটনার কথা জানতে পারি। তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে যাই এবং জানতে পারি একটি লোক প্রায় ৭০ খানা বাচ্চাকে বন্দি করে ফেলেছে। পুলিশের লোককে দেখলেই বলছে কেউ ঢুকবে না গুলি মেরে দেব। আমাদের কোনও উপায় ছিল না। স্কুলের পিছনের দিকে একটা পাঁচিল আছে, সেখানে গিয়ে আমি একটি লোকের কাছ থেকে একটি টি-শার্ট নিয়ে পরি এবং আমার ইউনিফর্মটা খুলে ফেলি, এমনকি পুলিশের জুতো খুলে চটি পরি, সাধারণ ভাবে স্কুলে ঢুকি। আমার সঙ্গে এসআই দিলীপ হালদারকে নিয়ে ঢুকি। দিলীপ হালদারকে বলি আপনি এখানে থাকেন, আমি মিডিয়াম্যান সেজে যাচ্ছি, হাতে মোবাইল নিয়ে সাংবাদিকদের মতো স্কুলের ক্লাসরুমের মধ্যে থাকা বন্দুকবাজের কাছে পৌঁছে যাই। কথা বলতে বলতেই সুযোগ খুজছিলাম কখন লোকটার নজর আমার থেকে সরে। সুযোগ পেতেই ওই ব্যক্তির উপরে ঝাপিয়ে পড়ি। লোকটিকে পুরোপুরি কাবু করতে মালদহ থানার অফিসার দিলীপ হালদার, আমার নিরাপত্তারক্ষী, দুই সিভিক ভলান্টিয়ার এবং এক গ্রামীণ পুলিশ আমাকে সহযোগিতা করেন। তারপর বাচ্চাদের উদ্ধার করে বের করে দেওয়া হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct