একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা প্রতিটা ক্লাসে যত কমই হোক না কেন, পাঁচ জন সহকারী শিক্ষক এবং একজন প্রধান শিক্ষক থাকা জরুরি। ছাত্র কম আছে বলে শ্রেণী-ভিত্তিক শিক্ষক না দিয়ে যে কজন ছাত্রছাত্রী রয়েছে,তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক তৈরি করার কারো কোনো অধিকার নেই। এখন প্রশ্ন হলো রাইট-টু-এডুকেশন অ্যাক্টে শ্রেণী ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি,এখানে ছাত্র সংখ্যাকেই মাপকাঠি ধরা হয়েছে। কোনো সরকারি নির্দেশ এই আইনের বদল ঘটাতে পারে না। এ নিয়ে লিখেছেন সনাতন পাল।
রাজ্য শিক্ষা দপ্তর থেকে সরকারি ভাবে একটা তালিকা বের করা হয়েছে। সেই তালিকায় এমন ৮২০৭ টা প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম রয়েছে, যে বিদ্যালয় গুলিতে ৩০ জনের কম ছাত্রছাত্রী রয়েছে। শোনা যাচ্ছে ওই স্কুল গুলি নাকি পার্শ্ববর্তী স্কুলের সাথে জুড়ে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সরকার,শিশু এবং শিক্ষার স্বার্থেই যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশা করাটা নিশ্চয়ই অপরাধের হবে না। ২০১৫ সালের হিসাব অনুসারে এ রাজ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৬৭০৩। এর মধ্যে থেকেই প্রাথমিক সহ উচ্চ প্রাথমিকের এই যে ৮২০৭ টা বিদ্যালয়ে ৩০ এর নিচে ছাত্র সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? জনসংখ্যা কি কমে যাচ্ছে! নাকি ভিন্ন কোনো কারণ আছে? এই কারণ কি সত্যিই অনুসন্ধান করা হয়েছে? যদি এর কারণ অনুসন্ধান করে সঠিক সুরাহা করা না যায়,তাহলে এই ৮২০৭ টা স্কুলকে অন্য স্কুলের সাথে যুক্ত করে দিলেও সমস্যার সঠিক সুরাহা হবে বলে মনে হয় না। হয়তো দেখা-যাবে পরের বছর আরও কয়েকশো স্কুলের ছাত্র ৩০ এর নীচে নেমে গেছে। বাস্তবে বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে। তার পরের বছর হয়তো এমন আরও কিছু এমন স্কুলের নাম আসবে। হয়তো এমনটা চলতেই থাকবে। রাজ্যের বহু স্কুলে ছাত্র থাকলেও শ্রেণী ভিত্তিক শিক্ষক নেই। ধরা যাক কোনো একটা স্কুলে প্রতিটা ক্লাসে ১০ জন করে পাঁচটা ক্লাসে মোট ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। সেখানে রাইট-টু-এডুকেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী ২ জনের বেশি শিক্ষক নেই। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-স্কুল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুজন শিক্ষক দুটো ক্লাসে পর্যায়ক্রমিক যাচ্ছেন। আর তিনটে করে ক্লাস ফাঁকা থাকছে। এই ফাঁকা সময়ে ঐ তিনটে ক্লাসের বাচ্চারা হয় বাইরে বেরিয়ে দৌড়াদোড়ি করছে কিংবা শিক্ষক দ্বয় তাদের ক্লাসে কিছু করতে বলে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ স্কুলটিতে ঠিকঠাক পড়াশোনা হচ্ছে না। সেটা দেখে পরের বছর হয়তো ততো সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তিই হলো না,যত সংখ্যক বেরিয়ে গেল। অভিভাবকরা হয়তো ভাবছেন যে, ঐ স্কুলে শিক্ষকই নেই তো সেখানে বাচ্চার ভবিষ্যত নষ্ট করতে ভর্তি করবেন কেন! ফলে বাস্তবে ঐ সমস্ত স্কুলের বাচ্চা কমে যাচ্ছে। এই ভাবেই দিন দিন সরকারি বহু স্কুল গুলিতে পড়ুয়া কমে যাচ্ছে। অবশ্যই ছাত্র কমে যাওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই বাচ্চা গুলো যাচ্ছে কোথায়? যাঁদের একটু সামর্থ্য আছে,তাঁরা সকলেই হয়তো বেসরকারি স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করছেন। এই প্রক্রিয়া চালু থাকলে সমস্ত সরকারি স্কুল একটা সময় উঠে যাবে। কিন্তু স্কুল গুলিতে ছাত্র সংখ্যা কম হলেও যদি শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষক থাকেন,তাহলে নিয়মিত পঠন-পাঠনের মাধ্যমে স্কুল গুলি প্রাণ ফিরে পেতে পারে। এতে যেমন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন বাঁচবে,তেমনি গরীব বাবা-মায়ের ঘাড় থেকে বাড়তি চাপ মুক্ত হবে।
একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা প্রতিটা ক্লাসে যত কমই হোক না কেন, পাঁচ জন সহকারী শিক্ষক এবং একজন প্রধান শিক্ষক থাকা জরুরি। ছাত্র কম আছে বলে শ্রেণী-ভিত্তিক শিক্ষক না দিয়ে যে কজন ছাত্রছাত্রী রয়েছে,তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক তৈরি করার কারো কোনো অধিকার নেই। এখন প্রশ্ন হলো রাইট-টু-এডুকেশন অ্যাক্টে শ্রেণী ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি,এখানে ছাত্র সংখ্যাকেই মাপকাঠি ধরা হয়েছে। কোনো সরকারি নির্দেশ এই আইনের বদল ঘটাতে পারে না। সুতরাং শিক্ষার অধিকার আইন মানা ছাড়া সরকারের কাছে উপায় নেই। এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কিসের জন্য আইন? কার জন্য আইন? আইন প্রণয়নের সময় স্ট্যান্ডিং কমিটিতে ভালো মন্দ সমস্ত দিক ক্ষতিয়ে দেখে সম্পূর্ণ নাগরিক স্বার্থেই আইন প্রণয়ন করা উচিত। এটা অবশ্যই দেখা উচিত যাতে কোনো আইনের ফলে একজন নাগরিকও বঞ্চিত না হয়। যদি কোনো কারণে এর ব্যতিক্রম ঘটে তখন অবশ্যই আইন বদল করা জরুরি । এ ক্ষেত্রে আদালত খানিকটা অসহায়। আইন সভায় যে আইন পাশ করা হয়,আদালত সেই আইনের ভিত্তিতেই বিচার করে থাকে। এই ক্ষণে অতিরিক্ত শিক্ষক অ্যাডজাস্ট করার দাবিতে মামলা হলে শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী আদালত অ্যাডজাস্ট-মেন্টের পক্ষে রায় দেবে এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে আদালত অবমাননার ভয়ে শিক্ষকদের ছাত্র সংখ্যা অনুযায়ী অ্যাডজাস্ট করে বদলি করে সমস্যা কখনই পুরোপুরি সমাধান হবে না। কিন্তু আদালতেরই বা কি করার আছে! তাই সবার প্রথমে শিক্ষার অধিকার আইনটাই সংশোধন করার দাবীকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো\ যাঁরা আইন সংশোধন করবেন,তাঁরা প্রত্যেকেই আইন সভার সদস্য। তাঁরা সব সময়ই নিজ নিজ দলের মতামতকে আইন সভাতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে থাকেন । তাই শাসককে একথা ভাবা অবশ্যই দরকার যে ,আইন সভা কারো দান করা দু- বিঘা জমি নয়,যে যখন খুশি তখন ইচ্ছে মতো শুয়োর দিয়ে খাওয়াবেন। আইন সভাতে সম্পূর্ণ নাগরিক স্বার্থে আইন যেমন প্রনয়ন করা হবে,তেমনি প্রয়োজনীয় সংশোধনও করতে হবে। মাননীয় আইন সভার সদস্যগণের কাছে বিনীত অনুরোধ, শিক্ষার স্বার্থে আপনারা শিক্ষার অধিকার আইন-৯ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন করুন।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct