চাকরির শুরু থেকে কেরালায় কর্মরত ৫০-৫২ বছরের “মিঠুন সেন” বদলি হয়ে কলকাতায় পোস্টিং হলেন। কলকাতায় ওই সংস্থার অফিসে স্টাফ প্রায় ১০০ জন, তার মধ্যে মিঠুনের ঘরে প্রায় ৩০ জন। এখানে আসার কিছু পর সহকর্মীরা মিঠুনের নাম দিল “পচা মাছ”। মিঠুন কোনও স্টাফের টেবিলে গেলে, পাশের টেবিলে কেউ আওয়াজ দেয় পচা মাছ। মিঠুন অফিসে ঢুকলে কয়েকজন স্টাফ বলে ওঠে পচা মাছ। তার প্রতি এই ‘মানসিক’ অত্যাচারের কথা তুলে ধরে নিজের উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সবাই মিলে একজনকে নির্যাতন করে আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা বাঙালির মত আর কার আছে জানি না। এটা চাকরি স্থলে হলে তার পরিণতি যে কত ভয়ংকর হতে পারে নীচের ঘটনাটা তার প্রমাণ। চাকরির শুরু থেকে কেরালায় কর্মরত ৫০-৫২ বছরের “মিঠুন সেন” বদলি হয়ে কলকাতায় পোস্টিং হলেন। কলকাতায় ওই সংস্থার অফিসে স্টাফ প্রায় ১০০ জন, তার মধ্যে মিঠুনের ঘরে প্রায় ৩০ জন। এখানে আসার কিছু পর সহকর্মীরা মিঠুনের নাম দিল “পচা মাছ”। মিঠুন কোনও স্টাফের টেবিলে গেলে, পাশের টেবিলে কেউ আওয়াজ দেয় পচা মাছ। মিঠুন অফিসে ঢুকলে কয়েকজন স্টাফ বলে ওঠে পচা মাছ।কাজের জন্য মিঠুন অন্য ঘরে গেলে সেই ঘরের কিছু কর্মী বিকৃত স্বরে ধ্বনি তোলে পচা মাছ। মিঠুনের সঙ্গে যারা এইরকম করে, তারা কেউ সমাজবিরোধী নয়, বরং মানসিক সুস্থ ও সামাজিক মানুষ বলেই পরিচিত। দুঃখ করে মিঠুন তাঁর এক আত্মীয়কে লাঞ্ছনার কথা জানাতে তিনি বলেছিলেন,” এখানে জয়েন করার পরইতুমি হয়ত তাঁদের সামনে এমন কোনও আচরণ করেছিলে, যার জন্য ওরা তোমার সঙ্গে এইরকম করে”। মিঠুনের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এসব শুনে বলেছিলেন, “অফিসে তোর কথাবার্তা, আচরণের মধ্যে এমন কিছু অস্বাভাবিকত্ব ফুটে ওঠে, যাতে ওদের তোর সাথে এইরকম করার ইচ্ছা জাগে”। উভয়েই বলেছিলেন, “এগুলো নিজেকেই সামাল দিতে হবে, কেউ কোনও সুরাহা করে দেবেনা”।নির্যাতনের ব্যাপারে পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে এইসব কথাবার্তামিঠূণের দগ্ধ মনকে আরও জ্বলিয়ে দিয়েছিল।
সায়ন নামে ২৮-৩০ বছরের একটি ছেলে নতুন ওই অফিসে জয়েন করল। তার পাশের টেবিলে মিঠুন কোনও কাজে যেতে, সে’ও অন্য দিকে মুখ ঘূরিয়ে, আস্তে বলে উঠল, ‘পচা মাছ’।যাঁরা বলতেন,”এখানে জয়েন করার পরই তুমি তাঁদের সামনে এমন আচরণ করেছিলে “,তাঁরা এখন কি বলবেন, মিঠুনএখানে জয়েন করার সময় তো এই ছেলেটি ছিলই না ? সমাজে একজনকে অবজ্ঞা এবং হেনস্থা করা শুরু হলে সেটা এইরকম গড্ডালিকা প্রবাহে চলতে থাকে,নবাগতরাও তাতে গা ভাসায়। শুধু ‘পচা মাছ’ বলা নয়, আরও অবজ্ঞা সহকর্মীরা মিঠুনকে করত। সেদিন বেলা ১.৩০ মিনিট নাগাদ কিছু পেটভরা খাবার এনে মিঠুন সমেত অফিসে সবার টেবিলে দেওয়া হল। মিঠুন শুনলেন, ৫৫ বছর বয়সী মহিলা কর্মী জয়িতা দাস তাঁর নাতির জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে খাওয়াচ্ছেন এবং আগের দিন তিনি এটা সবাইকে বলে রেখেছিলেন, যেন কেউ টিফিন না আনে। যারা অফিসে ছিলনা, তাদের তিনি ফোনেও বলেছিলেন অথচ মিঠুনকে তিনি বলার প্রয়োজন মনে করেননি। অপমানিত মিঠুন সেটা খাননি। সহকর্মীরা বলেছে, ‘ওর বেশি দেমাক, ওকে কি পায়ে ধরে বলতে হবে “? তবে এটাই প্রথম নয়,এর আগেও ২-৩ জন সহকর্মী মিঠুনের সাথে এইরকম আচরণ করেছে।
একটি পুরোনো সার্কুলার আনতে অফিসার মিঠুনকে পাশের ঘরে পাঠিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট স্টাফ ‘সুবীর’ মিঠুনকে কাগজটা দিতে মিঠুন জিজ্ঞেস করলেন্,” এটা বাড়তি কপি,না জেরক্স করে ফেরত দেব”? মহামান্য (!) কর্মী সুবীর এক হেঁচকা টানে সার্কুলারটা মিঠুনের হাত থেকে কেড়ে নিলেন। পাশে একজন বিকৃত স্বরে আওয়াজ দিল ‘পচা মাছ’।‘তুহিন’ নামের পাশের সিটের এক বিজ্ঞ (!) কর্মী ফিকফিক হেসে উঠল। রক্ত-মাংসের মানুষ মিঠুন আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তুহিনকে মারলেন এক ধাক্কা। তুহিন পড়ে গেল। অপমানে জর্জরিত মিঠুন পড়ে যাওয়া তুহিনের মুখে মারলেন বুটের এক লাথি।একটা লাথি পড়তেই পাশে থাকা একজন তাড়াতাড়ি মিঠুনকে জাপটে ধরে সরিয়ে নিল। দ্রুত আর পাঁচজন ছুটে এসে মিঠুনকে ধরে না ফেললে এবং চোট মাথায় লাগলে হয়ত আরও মারাত্মক কিছু ঘটে যেত। তবে, বুটের লাথিতে তুহীনের গালে রক্ত চলে এল। মিঠুনের মত মানুষদের সম্পর্কে অনেকে বলেন,” লোকটার মাথায় রোগ আছে, তাঁর চিকিৎসার দরকার”। কেউ বলেন,“ সহ্যশক্তি, কম, পাঁচজনকে নিয়ে চলার মানসিকতা নেই”। কিন্তু ধারণাটা ভুল। কলকাতারই এক অফিসে ‘ সুখেন রায়”- এর ওপর হওয়া এইরকম অত্যাচার একজন মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাননীয় মন্ত্রী ছিলেন সুখেন রায়ের এক বন্ধুর বাবা। বড় ট্রেড ইউনিয়ন নেতা শ্বশুরের প্রভাবে কর্মস্থলে “ রাহুল”- এর বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু মিঠুনের পাশে সে’রকম কেউ ছিলেন না।তাই নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, পুলিশ মিঠুনকে গ্রেফতার করে আদালতে চালান করল। আইনানুসারে মিঠুন চাকরিতে বরখাস্ত হলেন। ভারতীয় দণ্ডবিধির নির্দিষ্ট ধারায় মিঠুনের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হল। লাগামছাড়া অত্যাচারে অসহ্য হয়ে মিঠুন যা করেছেন সাধারণ মানুষের চোখে তা অপরাধ হলেও গভীরভাবে দেখলে মিঠুন বিরাট দোষী নন।আইন আছে যে, অত্যাচারে প্ররোচিত হয়ে অপরাধ করলে শাস্তি লঘু হয়,তবে তা’ প্রমাণসাপেক্ষ। তাছাড়া, অত্যাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ধারাও আইনে আছে। কিন্তু বাস্তবে মিঠুনের মত কমজোর নির্যাতিতরা সেটার সুযোগ কি নিতে পারেন ? ভাগ্য প্রতিকূল হলে বিচার শেষেহয়ত মিঠুনের শাস্তি হবে জেল, যার আধুনিক ও গালভরা নাম ‘সংশোধনাগার’। আসল সংশোধনগুলো দরকার কোথায় ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct