মিশরের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং সরকারি অব্যবস্থাপনাসহ বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ সমস্যার ফল- যা সাম্প্রতিক বাহ্যিক সঙ্কট কোভিড-১৯ মহামারী, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্বমন্দার হুমকির সাথে মিলিত হয়েছে। এই পরিস্থিতির মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। কোভিড মহামারী দেশটির অন্যতম অর্থ উপার্জনকারী পর্যটন শিল্প ধ্বংস করেছে। তারপর ইউক্রেনের যুদ্ধ যেমন সেদেশকে ধ্বংস করছে, তেমনি ক্ষতির মুখে লেবানন, মিশর। এর পর কে, তা নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ প্রথম কিস্তি।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আলোচনা বিশ্ব গণমাধ্যমে সবসময় চলতে থাকে। নানা ইস্যু ছাড়িয়ে এবার আলোচনার কেন্দ্রে মিশর। এরই মধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি ভারতে এসে আরেক আলোচিত নেতা নরেন্দ্র মোদির সাথে কোলাকুলি করে গেছেন। মোদি সিসির সামনে ঘোষণা করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম একটি দেশের সাথে ভারত কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণের ঘোষণা দিচ্ছে। মোদি সর্বশেষ আলোচনায় উঠে এসেছেন মোদি ও গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে বিবিসির ‘ইন্ডিয়া: দি মোদি কোয়েশ্চন’ শীর্ষক ডকুমেন্টারি ঘিরে। গুজরাটের দাঙ্গাকালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের দিল্লি থেকে প্রেরিত এক গোপন প্রতিবেদন অবলম্বনে গুজরাটের দাঙ্গা আর এখনকার ভারতে মোদি জমানায় সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে সচিত্র রিপোর্ট স্থান পেয়েছে এই প্রামাণ্য চিত্রে। এক দশকের শাসনে আল-সিসি নানা সময় আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন। আলোচনার প্রধান কারণ ছিল নির্মম ও সহিংসভাবে ভিন্নমত দমন। রাবা স্কোয়ারের গণহত্যা নিয়ে ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে কোনো গোপন প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে কিনা জানা যায় না। তবে পাঠানো হলে সেই প্রতিবেদনের সাথে বিবিসির মোদি প্রতিবেদনের বেশ মিল পাওয়া যেত।
মিশরের দুর্দশার কাহিনী
মিশরজুড়ে এবারের আলোচনার মূলে রয়েছে অর্থনীতির চরম দুর্দশা। ইকোনমিস্ট সাময়িকীর মতে, মিশরের দর্শনীয় ধ্বংসাবশেষের তালিকায়, এখন যোগ হয়েছে এর অর্থনীতি। মিশরীয় পাউন্ড গত বছর অর্ধেক মূল্য হারিয়েছে এবং ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ-কার্যকরি মুদ্রার স্থান পেয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি সরকার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তৃতীয়বারের জন্য এর অবমূল্যায়ন করেছে। দেশটির রাজস্বের প্রায় অর্ধেক এখন যায় ঋণ পরিশোধে, যা জিডিপির ৯০ শতাংশের সমান। মিশরের আনুষ্ঠানিক, মুদ্রাস্ফীতি ২১ শতাংশ। তবে বাস্তবে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো অনেক বেশি। বিশেষভাবে খাবারের দাম অস্বাভাবিক দ্রুত বাড়ছে। কায়রোবাসীরা বলছেন, ‘আমরা এখন কেনাকাটা করতে গিয়ে তিন কেজির পরিবর্তে, এক কেজি বা আধা কেজি কিনতে বাধ্য হই।’ সরকারি পরিসংখ্যানের সাথে মিশরের অর্থনৈতিক অধঃপতনের তালমিল খুব কমই পাওয়া যায়। দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ দৈনিক দুই ডলারও খরচ করার সামর্থ্য রাখে না। আর এক তৃতীয়াংশ তাদের সাথে যোগদানের দ্বারপ্রান্তে। মিশরের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং সরকারি অব্যবস্থাপনাসহ বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ সমস্যার ফল- যা সাম্প্রতিক বাহ্যিক সঙ্কট কোভিড-১৯ মহামারী, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্বমন্দার হুমকির সাথে মিলিত হয়েছে। এই পরিস্থিতির মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। কোভিড মহামারী দেশটির অন্যতম অর্থ উপার্জনকারী পর্যটন শিল্প ধ্বংস করেছে। তারপর ইউক্রেনের যুদ্ধ বিশ্বের বৃহত্তম গম আমদানিকারক দেশটিতে গম সরবরাহ ব্যাহত করে। ২০১৪ সাল থেকে, রাষ্ট্রপতি সিসির নেতৃত্বে সরকার, ২৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম, চালকবিহীন মনোরেলসহ জাতীয় ‘মেগা-প্রকল্প’ বাস্তবায়নের কথা প্রচার করেছে। আর ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কায়রোর কাছে নতুন প্রশাসনিক রাজধানী শহর তৈরি করছে। এগুলো দেশে কৃত্রিমভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে। অনেক প্রকল্পে সেনাবাহিনীর বিশাল অর্থ উপার্জনের ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ককে যুক্ত করা হয়েছে। এই জাতীয় নীতিগুলি, মিশরের রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোকে অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দেয়, বেসরকারি খাতকে হতাশ করে, বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে এবং দেশটিকে বিদেশী ঋণের ওপর আরো নির্ভরশীল করে তোলে। এভাবে মিশরের বিদেশী পাওনা ১৫৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। আর জাতীয় আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সেই বিদেশী ঋণের দায় শোধে চলে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ রাবাহ আরেজকি গত ১৮ জানুয়ারি লিখেছেন, এই সব কারণ একত্রিত হয়ে সম্প্রতি মিশরকে ‘একটি আর্থিক ও অর্থনৈতিক অতল গহ্বরের দ্বারপ্রান্তে’ নিয়ে এসেছে। পরিস্থিতি এমন যে ডয়েচ ভ্যালের মতো গণমাধ্যমও প্রশ্ন তুলেছে, অর্থনৈতিক সঙ্কটে মিশর ‘নতুন লেবানন’ হতে যাচ্ছে কি না।
লেবানন সিনড্রম মিশরে
লেবাননের অনেক আলামত মিশরে দেখা দিতে শুরু করেছে। খাদ্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে, বেতন অর্ধেক হয়েছে। আর ব্যাংকগুলো টাকা উত্তোলন সীমিত করে দিয়েছে। এখন লেবানিজদের মতো একই সমস্যার মুখে মিশরীয়রা। তবে ১০ কোটির বেশি মানুষের দেশে যদি পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়, তাহলে ফলাফল ভয়ঙ্কর হতে পারে। লেবাননে, হতাশ স্থানীয়রা কেবল তাদের নিজের সঞ্চয় তুলে নেয়ার জন্য ব্যাংক লুট পর্যন্ত চলে গেছে, শহরগুলো অন্ধকারে নিমজ্জিত, কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর মত জ্বালানি নেই। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ঋণের চক্রে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মিশরে পরিস্থিতি এখনো অতদূর যায়নি। কিন্তু কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করছে, মিশর কি শিগগিরই ‘নতুন লেবানন’ হয়ে উঠতে পারে? হ্যাঁ, দুই দেশের তুলনা হয় না, তবে মিশর এবং লেবাননের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মিশরীয় দারিদ্র্যের মাত্রা লেবাননের কাছাকাছি যেখানে মিশরীয়দের অন্তত ৬০% দারিদ্র্যসীমায় বা এর কাছাকাছি বাস করে। কানাডার সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক রবার্ট স্প্রিংবর্গ, লিখেছেন, ‘চরমভাবে ব্যর্থ লেবাননের অর্থনীতি এবং দুর্দশার সাথে লড়াইরত মিশরের অর্থনীতির মধ্যে এখন উল্লেখযোগ্য মিল সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘লেবাননে আত্মবিশ্বাসের কারণে পতনের পরিণতিগুলো ধ্বংসাত্মক হয়েছে, তবে মিশরীয় স্কেলে এর পুনরাবৃত্তি হলে সেটিও প্রায় তুচ্ছ হয়ে যাবে।’ মিশরের রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ এবং মধ্যপ্রাচ্য নীতির জন্য তাহরির ইনস্টিটিউটের পলিসি ফেলো টিমোথি কালদাস বলেছেন, ‘দুই দেশের রাজনৈতিক অভিজাতদের রাষ্ট্র এবং জনসাধারণের টাকায় নিজেদের সমৃদ্ধ করার ইচ্ছা আছে। এটি অবশ্যই এমন কিছু যা দুটি দেশ ভাগ করে নেয়।’ কার্নেগি ইনস্টিটিউটের ইয়েজিদ সাইঘ বলেছেন, ‘কিছু মিল থাকা সত্ত্বে ও দারিদ্র্য এবং দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো অনেক আরব দেশে অভিন্ন, তাই আপনি সহজ তুলনা টানতে পারবেন না। এ ছাড়াও, মিশরীয় সরকার লেবাননের মতো একইভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তার সব সমস্যার পরও, মিশর মৌলিকভাবে লেবাননের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল রয়েছে। এটি লেবাননের মতো পুরোপুরি পতনের দ্বারপ্রান্তে নয়।’কালদাস উল্লেখ করেছেন, ‘সুয়েজ খাল, পর্যটন শিল্প এবং বিভিন্ন রফতানি শিল্পের জন্য, মিশরের অর্থনীতিতে লেবাননের তুলনায় নগদ অর্থের বেশি সম্ভাব্য উৎস রয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct