নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা, আপনজন: একসময় কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কে নিয়ে শাসক দলের আইনজীবীদের বিক্ষোভ প্রদর্শন ছিল, এখন সেটা বিচারপতি রাজশেখর মান্থার ঘিরে। বিচারপতি রাজশেখর মান্থারের একের পর এক নির্দেশে নাজেহাল রাজ্য সরকারের পুলিশ - প্রশাসন। বিরোধী দল নেতা শুভেন্দু অধিকারী কে আইনী রক্ষাকবচ দেওয়া থেকে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এর শ্যালিকা মেনকা গম্ভীরের রক্ষাকবচ খারিজ। আবার কখনো বা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় আনন্দপুরের ঘটনায় রাজ্য পুলিশ কে গাইডলাইন বেঁধে দেওয়া। সোমবার সকাল সাড়ে দশটায় হাইকোর্টের বিচারপতি রাজশেখর মান্থার এজলাসের (১৩ নং ঘর) বাইরে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয় তৃণমূল আইনজীবীদের একাংশের। এজলাসের বাইরে গেট আটকে কোর্ট বয়কটের ডাক দেন তাঁরা। এর ফলে বিচারপতি মান্থার এজলাসে বিচার প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর একটি মামলায় বিচারপতি রাজশেখর মান্থার রক্ষাকবচ দিয়েছিলেন।
কেবল তাই নয়, তিনি এটাও নির্দেশ দিয়েছিলেন, শুভেন্দুর বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর করতে হলে, যেন তাঁর এজলাসেই মামলা করা হয়। বিচারপতির এই রায় আসার পর বিভিন্ন সময়ে তৃণমূল নেতৃত্বকে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায়। সোমবার তারই প্রতিবাদে এবার বিক্ষোভ করতে দেখা গেল তৃণমূলপন্থী আইনজীবীর একাংশকে।এদিন সকাল থেকেই বিচারপতি রাজশেখর মান্থার এজলাসের বাইরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তৃণমূলপন্থী আইনজীবীরা। বিচারপতির এজলাসের বাইরে যে গেট রয়েছে, সেটাও দিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। মহিলা আইনজীবীরা সামনে দাঁড়িয়ে বিরুদ্ধাচ্চরণ করছেন বলে অভিযোগ ওঠে। কেউ যাতে ভিতরে প্রবেশ করতে না পারেন, তার জন্য বাধা দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ। বিচারপতির এজলাসের বাইরে এ ধরনের বিক্ষোভ নজিরবিহীন বলে মনে করছে আইনজীবীদের একাংশ। প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য-সহ অন্যান্যরা। প্রধান বিচারপতি এদিন বলেন, ” সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হচ্ছে। সমস্যা মিটিয়ে নিন। না হলে পদক্ষেপ করা হবে।”প্রধান বিচারপতির বক্তব্য, -' এই ঘটনা ইতিমধ্যে টুইটারে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টেরও নজরে আসবে। ভিডিয়োগুলো যদি সুপ্রিম কোর্টের নজরে আসে, তাহলে হাইকোর্টের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে'। আইনজীবী শ্রীজীব চক্রবর্তী গোটা বিষয়টি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “কী ভাবে একজন বিচারপতির এজলাসের বাইরে ধর্না দিয়ে প্ল্যাকার্ড তুলে বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে?” গোটা বিষয়টির ছবি তিনি প্রধান বিচারপতির সামনে তুলে ধরেন।প্রধান বিচারপতি এজলাসে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে নিন্দাপ্রকাশ করেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও। তাঁর আবেদন, বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে ডেকে প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি তোলা হোক। এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, “বারের সভাপতি এবং রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলকে ডেকে পাঠান। তাঁদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই। বিচারপতির এজলাস কী ভাবে বয়কট করা যেতে পারে?” প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, “এটা উচিত নয়। সব তথ্য প্রমাণ নিয়ে আসুন। বারের সভাপতি ডেকে পাঠাচ্ছি। এই ঘটনা হওয়া উচিত নয়। বিষয়টি আমরা দেখেছি।”প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব আপাতত এজি সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ডেকে নির্দেশ দিয়েছেন, বিষয়টি দেখার। এজি বলেন, “আমি এখনই বিষয়টি শুনলাম। আমি দেখছি।”। এদিন হাইকোর্টে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার শতাধিক মামলা শোনার কথা ছিল। তিনি মামলা না শুনেই উঠে যান।এর আগেও বিচারপতির মান্থার এজলাস বয়কট করা নিয়ে রাজ্যের শাসক পক্ষের আইনজীবী ও বিরোধী দলের সপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ঝামেলার সৃষ্টি হয় । ফের তা দেখা গেল সোমবার।এ ব্যাপারে সকালেই প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কেন্দ্রের ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল বিল্বদল ভট্টাচার্য । বিচারপতি মান্থার এজলাসের বাইরে ধরনা দিয়ে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন আর এক আইনজীবী শ্রীজীব চক্রবর্তী । আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রধান বিচারপতির এজলাসে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে নিন্দা প্রকাশ করেন । তাঁর আবেদন, -'বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে ডেকে প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি তোলা হোক' ।তারপরই রাজ্য সরকারের আইনজীবী কে ডেকে প্রায় ধমক দেন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব । তিনি বলেন,"যাঁরা এইভাবে বিচারপতির এজলাস বন্ধ করছেন, কোর্ট ব্যবস্থা নিলে তাঁরা সামলাতে পারবেন তো ? সুপ্রিম কোর্টের এই নিয়ে নির্দেশ আছে । আইনজীবীদের জন্য কিছুই নেই এমনটা নয় । এইভাবে চলতে পারে না । আমরা কোনও পদক্ষেপ করলে তাঁরা কী করবে, সেটা ভেবে দেখতে বলুন । বার অ্যাসোসিয়েশন কী করছে ? প্রেসিডেন্টকে দেখা করতে বলুন ।"এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের আইনজীবী এসে প্রধান বিচারপতিকে জানান, -' তিনি সবেমাত্র বিষয়টি জানতে পারলেন । কেন হচ্ছে বুঝতে পারছেন না । এই সব সুপ্রিম কোর্টে গেলে এদের সমস্যা তৈরি হবে । ছবি, ভিডিয়ো সব রয়েছে । কেন সমস্যা ডেকে আনছেন' । এই ঘটনার পরই প্রধান বিচারপতি, বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও সবপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন তিনি ।সোমবার সকালেই এজলাসের সামনে আইনজীবীদের বিক্ষোভের জেরে এজলাস ছেড়ে বেরিয়ে যান বিচারপতি মান্থার। পাশাপাশি বিচারপতির যোধপুর পার্কের বাড়ির সামনেও জমায়েত করে তৃণমূল । পোস্টার লাগানোর পাশাপাশি শুরু হয় বিক্ষোভ । ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছয় পুলিশ । উল্লেখ্য, বিচারপতি রাজশেখর মান্থার একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন বলে আগেই অভিযোগ তুলেছিল শাসকপক্ষের আইনজীবীরা ।এদিন ১৩ নম্বর এজলাস বয়কট নিয়ে প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি হরিশ ট্যাণ্ডন, বিচারপতি টিএস সিভগ্নানামন ও রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বৈঠকে বসেন । প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টে অবস্থানের ভিডিয়ো ও ছবি তাঁদেরকে দেখান । হাইকোর্ট সূত্রে খবর, অবস্থানের ভিডিয়ো ও ছবি প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টে পাঠাতে পারেন বা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করতে পারেন । জানা গিয়েছে, যে সমস্ত আইনজীবীর এই বয়কট করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে বলে এদিনের বৈঠকে জানান ক্ষুব্ধ প্রধান বিচারপতি । হাইকোর্ট চত্বরের বিভিন্ন জায়গায় বিচারপতি রাজশেখর মান্থার বিরুদ্ধে পোস্টার পড়তেও দেখা গিয়েছে এদিন ।সম্প্রতি তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ কে তীব্র আক্রমণ করতে দেখা গিয়েছিল বিচারপতি রাজশেখর মান্থার ঘিরে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct