রিক্সাওয়ালা
হাবিবুর রহমান
কাল চরকির মতন ঘুরছে। হরি অনেক কাল আগে স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে দিনটা কতক কলেজে গেছলো। গরীবের সংসারে বাবামা আর টানতে পারেনি।বেকার যুবক ।ঘোরাঘুরি সার। তেমন কাজকর্ম জুটলনা। বাপে রিক্সা টানতো। বুড়ো বাপের কষ্ট দেখতে না পেরে ,ছেলে বাপের সাহায্য করতো। তারপর পার্মানেন্ট রিক্সাওয়ালা।সেই কবেকার কথা।জোয়ান মরদ। রোদ জল ঝড় সব সয়ে গেল।ভিন গাঁয়ের জবুনার সঙ্গে দেখাশোনার বিয়া।কালের নিয়মে পোলাপানে ঘর আলো করলো। এক ছেলে, দুই মেয়ে। গরিবানা মতে, মেয়েদের বিয়ে হলো।ছেলে রমেন,পড়াশোনায় ভাল।হরি নিজের রক্ত জল করে ছেলেকে পড়াতে থাকে।সেই ছেলে বি এ পাশ দিল।দাদামামা কেউ নেই।কে দেবে রমেনকে চাকরি?ফ্যাফ্যা করে ঘোরে।গরীবের ঘরে শিক্ষিত বেকার। করার কিছু নেই,যেন বোঝা।দিন কেটে যায়। কিন্তু সময়ের ডাক,কোন ফাঁকে মিলি রমেনের জীবনের আঁচলে গিট বাঁধে।প্রেম গভীর হয়।মিলি রমেনকে বলে,চল, দুজনে হোগলা নদীর চরে, কী সুন্দর জায়গা, শান্তপরিবেশ।আর কত পাখির মেলা।দেখলে প্রাণ জুরিয়ে যাবে।মাথা নেড়ে রমেন সায় দেয়, নো প্রবলেম,চল ঘুরে আসি।আর মনে মনে বলে, গতকাল তো ঝই ঝামেলা করে বাবার থেকে দুশো টাকা হাতিয়েচি। ব্যাস, ওতেই চালিয়ে নোব।কথামত সেদিন বিকেলে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে রওনা দিল।কিছুদূর যাওয়ার পর মিলি বলে,রমেন, আর পারছিনা হাঁটতে গো।রমেন বলে,চল, একটা রিক্সা করি।মিলি বললে, ঠিক তাই।
সেই সময় পিছন থেকে একটা রিক্সা আসছিল। একমুখ পাকাদাড়ি, মাথায় ফেটিবাঁধাএক রিক্সাওয়ালা ।একটু আগে যেয়েই মিলি তাকে জিগালো , ও রিক্সাওয়ালা- রিক্সাওয়ালা,হোগলের চরে যাবাগো?রিক্সাওয়ালা সামনে তাকিয়ে বললে,যাবো গো মা,যাবো।মিলি রিক্সায় উঠোল,রমেন উঠতে যাবে,তখন রিক্সাওয়ালা পিছনে মুখ ফেরায়।রমেন ওই মুখ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। আস্তে করে রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ায়,আর মিলিকে বলে, নেমে এসো মিলি- নেমে এসো।মিলি তর্ক করে, বারে, কেন নামবো রিক্সা থেকে?কত কষ্টে রিক্সাটা পেলুম।এদিকে সহজে রিক্সা পাবে নাকি?রমেন রেগে যায়, বলছি নামো রিক্সা থেকে। পরে রিক্সা ঠিক পেয়ে যাব। আর,না পেলে হেঁটে যাবো।মিলি আরো রেগে যায়, ত্তা, হঠাৎ তোমার হলোটা কি বলবে তো?রমেনও রেগে বলে, কিছুই হয়নি আমার। তুমি প্লিজ নেমে এসো।তর্ক করোনা।এতক্ষনে রিক্সাওয়ালা মুখ খোলে,মাগো,তুমি বাবুর কে হও গো মা।মেয়েটি রেগে যায়, এতো বয়স হলো, বুঝতে পারছনা আমি বাবুর কে হতে পারি?রিক্সাওয়ালা মাথার ফেটটি খুলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললে,অনুমান কিছুটা করে ছিলুম গো মা,তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছিলাম।তা বাবু না গেলে তুমি চলনা মা,তোমাকে পৌঁছে দিই।মিলি আরো রেগে যায়,তুমি কেডা হে রিক্সাওয়ালা? তোমাকে কে মোরলি করতে বলেছে?রিক্সাওয়ালা কাতর কণ্ঠে বলে, সত্যি তো মা আমি কেডা? তা জিগাও না তোমার বাবুরে,কেডা আমি?মিলি রাগান্বিত স্বরে বলে,এই রমেন,তুমি চুপ কেন? বলনা, এই ফালতু লোকটাকে চেনো কিনা? তখনও রমেনকে চুপ থাকতে দেখে রিক্সাওলার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরলো,আর মুখ দিয়ে বেরোলো,মাগো, তোমার বাবুটি নব্য সভ্য শিক্ষিত মানুষ। ও আমারে কেমনে চিনবে? একমুখ পাকা দাড়ি ,ময়লা কাপড় চোপড়, বুড়ো মানুষ আমি। রোদ জলে রিক্সা টানি। আমি যে রিক্সাওয়ালা গো মা। ও আমারে চিনবে কেমনে?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct