ইউক্রেন ইউরোপের ঢাল হয়ে উঠেছে—চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতে আজকের দিনের বাস্তবতা এটাই। ইউরোপের সঙ্গে ইউক্রেনের যে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, তার সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এখন ইউরোপের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ইউরোপকে রক্ষার প্রশ্নে বিষয়টি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাশিয়ার পতনই কেবল ইউরোপের জন্য মহাশঙ্কা হয়ে ওঠা হুমকিকে হ্রাস করতে পারে। বিগত ১০ মাসে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এ নিয়ে লিখেছেন আলেক্সি রেজনিকভ। আজ প্রথম কিস্তি।
সত্যি বলতে, আজকে যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি চলছে, নিরাপত্তা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে, রাশিয়াকে যদি চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা না যায়, তবে তার জন্য বিশাল মাশুল গুনতে হবে ২০২৩ সালে। ভূরাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেওয়ার ফল যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, বিশ্ব ইতিমধ্যেই তা টের পেয়েছে মর্মে মর্মে ২০২১ সালে আমি বলেছিলাম, ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে ইউক্রেন যুদ্ধের চূড়ান্ত মীমাংসার ফলাফলের ভিত্তিতে। বছর শেষে হিসাব কষে দেখা যাচ্ছে, আমার সেই কথা বাস্তব হয়ে প্রতিঘাত করছে। আমার সেই সাহসী বিবৃতি এখন স্বীকৃত সত্য। ইউক্রেন ইউরোপের ঢাল হয়ে উঠেছে—চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতে আজকের দিনের বাস্তবতা এটাই। ইউরোপের সঙ্গে ইউক্রেনের যে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, তার সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এখন ইউরোপের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ইউরোপ মহাদেশকে রক্ষার প্রশ্নে বিষয়টি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগামী দিনের বাস্তবতা হলো, কেবল ইউক্রেনীয় বাহিনীর সফলতায় একটি করে নতুন পালক যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চলার পথ সহজতর হয়ে উঠতে পারে। রাশিয়ার পতনই কেবল ইউরোপের জন্য মহাশঙ্কা হয়ে ওঠা হুমকিকে হ্রাস করতে পারে।
বিগত ১০ মাসে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। পশ্চিমা বিশ্বকে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করার চিন্তায় কয়েক দশক ধরে প্রশিক্ষণ নেওয়া বিপুলসংখ্যক রাশিয়ান সেনা ইউনিট ধ্বংস করেছে ইউক্রেনের সেনারা। রাশিয়ান বাহিনীকে ইউক্রেনের সেনারা এমনভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে যে, রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে লেগে যাবে বছরের পর বছর। ইউক্রেনের বাহিনী বীরত্ব প্রদর্শন করেছে যদিও, তথাপি ইউরোপের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কৌশল ঢেলে সাজানো সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া শুরুর আগে অবশ্যই বিশেষ করে বিগত বারো মাসের ঘটনাগুলোকে আমলে নেওয়া জরুরি। মূলত ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তবেই পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমরা দেখেছি, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ শরণার্থী কতটা বেকায়দায় পড়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানি নিয়ে বিশ্ব কতটা হিমশিম অবস্থায় পড়েছে তা-ও অজানা নয় কারো। এসবের ফলে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট কতটা প্রকটতর হয়ে ওঠে, তাও হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ। পূর্ণ মাত্রায় রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হলে বিশ্ব যে চরম বেকায়দা পড়বে, বিশ্বব্যাপী যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, তা সারা বিশ্বের জন্য একটি চরম শিক্ষা হয়ে উঠবে। নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন নিয়ে যে কাণ্ড ঘটে এবং এর ফলে বিশ্ববাসী যে করুণ পরিণতি বরণ করতে বাধ্য হয়, তা আসলেই আমলে নেওয়ার বিষয়। এ ধরনের ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিলে সামনের দিনে বিশ্বের জন্য যে কী কঠিন বিপদ আসবে, তা ভাবলেও শিহরিত হতে হয়! নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন একটি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক প্রকল্প। এটাকেই টার্গেট করে বসেন যুদ্ধবাজ পুতিন। আজ এটা প্রমাণিত, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ‘স্বাভাবিক’ লেনদেন তথা রাশিয়ার সঙ্গে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। বাস্তবিক অর্থে, দেশটির সঙ্গে ইউরোপের ব্যবসা করার স্বাভাবিক পরিবেশ থাকবে বলেও মনে হয় না। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয় বটে, তাতে আশানুরূপ কাজ হয়েছে বলে দ্বিমত থাকতে পারে। অন্যদিকে ইউক্রেনকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছে পশ্চিমা বিশ্ব, যা যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে আসল ঘটনা অন্যখানে। আক্রমণ শুরুর আগেই কেন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি? এ নিয়ে তখন কথা বলা হলেও তা পাত্তা পায়নি। এমনকি একে ‘অসম্ভব’ বলেও মনে করা হয়। এই উপেক্ষা বড় চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে পরবর্তী সময়গুলোতে। পশ্চিমা বিশ্বের জন্যই শুধু নয়, বিপদ আছড়ে পড়ে রাশিয়ার নিজের মাটিতেও। পরবর্তীকালে মস্কো বিভিন্ন সন্ত্রাসী-আগ্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে অপরাধমূলক জোট গঠনের চেষ্টা করেছে, যা নিতান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানের ভূমিকা হতবাক করেছে সবাইকে। ইরানের ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইউক্রেনের বেসামরিক জনগণ ও স্থাপনা যেভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়, তা ছিল অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। এই প্রযুক্তিসহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিকট ভবিষ্যতে অন্য কোথাও মোতায়েন করা হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। এর ফলে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা যে ক্রমাগতভাবে হুমকির মুখে পড়বে তা বলাই বাহুল্য।
লেখক ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct