শিক্ষক নিয়োগ মামলা অনেক প্রশন জাগিয়ে তুলছে। সংস্কারমনস্কতা, উদারতা, শুদ্ধ উচ্চারণ, শুদ্ধ শিক্ষায় পরিপুষ্ট হয়ে দেশের তরে কাজ করে যায় নিরবধি আস্থা-অবিচল থেকে অবলীলায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না একজন আদর্শ শিক্ষক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সেই আদর্শ রক্ষার বিষয়ে মানুষের মনে এখন ব্যাপক তৈরি হচ্ছে, যেসব শিক্ষককে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। তালিকা দীর্ঘ হতে থাকায় আসলে ক্ষতি কিন্তু সমগ্র সমাজের, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এ নিয়ে লিখেছেন মোশারফ হোসেন।
ক্ষকতা একটি মহান পেশা, একটি মহান ব্রত। সমাজে যিনি শিক্ষা দান করেন বা যিনি নিজেকে শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত করেন তিনি হলেন শিক্ষক। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর সেই মেরুদণ্ড শক্ত করার কারিগর হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষক ছাড়া উন্নত সমাজ, টেকসই উন্নয়ন ও উজ্জ্বল জীবন কল্পনাতীত। কিন্তু রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, তা কিন্তু ভাবার বিষয়। একজন শিক্ষক যদি অন্যায় পথে নিয়োগ পান, তাহলে শিক্ষক হিসেবে তার আদর্শ তা কোথায় পৌঁছবে সে বিষয় েসন্দিহান হতেই হয়। অথচ, শিক্ষকরাই মূলত ছাত্রদের কাছ জীবনে বড় হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় সহায়ক।
শিক্ষক হিসেবে পৃথিবীতে কেউ জন্মান না, বরং বিশেষ প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়। একজন আদর্শ শিক্ষক জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক হবেন শিক্ষাব্রতী, নিরহংকারী, ছাত্রদরদি, দেশদরদি, সৎ, বিশ্বস্ত, আদর্শবান, চৌকস, দৃঢ়চেতা। তিনি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবেন, হবেন যথার্থ সেবাব্রতী, নিরপেক্ষ, অহমবোধ। তিনি হবেন নৈতিকতা, সততা, ধৈর্য-সহ্যশক্তিসম্পন্ন, কর্মে উদ্দীপনাসম্পন্ন, প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন, সময়নিষ্ঠাবান, প্রাণময়তা ইত্যাদি গুণের অধিকারী। শিক্ষক তাঁর হৃদয়ের অমলিন আনন্দ, আত্মবিশ্বাস, বিষয়ভিত্তিক অর্জিত জ্ঞানসম্পন্ন, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, পেশাগত দক্ষতা, আকর্ষণীয় বাকশৈলীর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত, উজ্জীবিত, সাহস জুগিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাবার দীক্ষা দিয়ে থাকেন। একজন শিক্ষক হলেন ছাত্রদের প্রতিষ্ঠার স্থপতি। তিনি ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনুকরণীয়-বরণীয় ও পথপ্রদর্শক। তাঁদের কাছে সমাজ তথা দেশ ও দশের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। চীনের প্রাচীন নেতা কনফুসিয়াস বলেছেন- “শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। তিনি হবেন একজন আদর্শ শাসক।” শিক্ষক সভ্যতার অভিভাবক, সমাজের অভিভাবক। শিক্ষক অক্লান্ত, পরিশ্রম ত্যাগ-স্বীকার, মূল্যবান সময় উজাড় করে দিয়ে এগিয়ে নিতে জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে অক্লান্তকর্মী হয়ে, অত্যন্ত ধৈর্য, সহনশীলতা, স্নেহ, মায়ামমতা, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। শিক্ষক তিন অক্ষর বিশিষ্ট একটি শব্দ। ‘শি’ মানে শিষ্টাচার, ‘ক্ষ’ মানে ক্ষমাশীল, ‘ক’ মানে কর্তব্যপরায়ণ। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্যকে গভীরভাবে ব্যাখ্যা বিশ্নেষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বহুবিদ কষ্ট সম্পাদন করেন। তিনি সুযোগ প্রদানকারী, সমস্যা নিরূপণকারী, সমস্যা সমাধানকারী, পরিকল্পনাকারী, পরীক্ষক-নিরীক্ষক, গবেষক, প্রত্যাবেক্ষক, মূল্যায়নকারী, দিকনির্দেশনাকারী, নেতৃত্বদানকারী নেতা, সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, পরামর্শদাতা।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষক সম্পর্কে বলেছেন, কৌতূহল জাগানো ও কৌতূহল নিবৃত্ত করা শিক্ষকের কাজ। তিনি ছাত্রদের যোগ্য করে তুলে জ্ঞানের দ্বারা তাদের পূর্ণ করেন। এভাবে দান গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটি পবিত্র নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধন সৃষ্টি হয়। সবুজ প্রাণের স্পন্দন জরাজীর্ণতা, নিশ্চলতা, অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা, অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে নাশ করে আলোকময় দিনের আলোক প্লাবনে নতুন সূর্য উদিত হয় শিক্ষক সমাজের স্বতঃস্ম্ফূর্ততায়। সভ্যতার শুরু থেকে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে জ্ঞানের আলোক রশ্মি ছড়িয়ে চলছে শিক্ষক সমাজ। তাই ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে শিক্ষক সমাজের সুমহান মর্যাদাস্বীকৃত, বরণীয়-গ্রহণীয়। তাই বলা যায়, শিক্ষকগণ জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় রোধ ও মূল্যবোধ জাগরণে জাতিকে জাগিয়ে তোলে। সামাজিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট না করে দশ ও দশের উন্নত করে আলোকিত মানুষ, আলোকিত সমাজ গঠন করে মশগুল থেকে স্বপ্ন পূরণের সারথি হন। সৃজনশীল চেতনাবান্ধব শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চায় উপলব্ধি তাঁকে তাড়িত করে। মহৎ কর্মের প্রকাশ ঘটে তাঁর যৌক্তিকবোধ, বিবেক বুদ্ধিদীপ্ততা, তেজদীপ্ততা, সংযম, ধীরস্থিরতা, আবার কখনও তড়িৎকর্মা, ভাব-গাম্ভীর্যতার মধ্য দিয়ে। সংস্কারমনস্কতা, উদারতা, শুদ্ধ উচ্চারণ, শুদ্ধ শিক্ষায় পরিপুষ্ট হয়ে দেশের তরে কাজ করে যায় নিরবধি আস্থা-অবিচল থেকে অবলীলায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না একজন আদর্শ শিক্ষক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সেই আদর্শ রক্ষার বিষয়ে মানুষের মনে এখন ব্যাপক তৈরি হচ্ছে, যেসব শিক্ষককে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। তালিকা দীর্ঘ হতে থাকায় আসলে ক্ষতি কিন্তু সমগ্র সমাজের, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct