নিশুতি রাতের কান্না
তাপস কুমার বর
“ভয়” এমন একটা আতঙ্ক মনের কোনে যদি একবার বসে যায়,সে বার বার দাঁত বের করে নিজেকে প্রহসনে পরিণত করে তোলে। সে প্রহসন হাসির নয়, একটা আতঙ্কের...... “কে ওখানে? কেউ নেই,হঠাৎ নিশুতি রাতের কান্না। রক্তের মধ্যে ঠান্ডা প্রবাহ বইছে”! ভূত,প্রেতাত্মা,ডাইনি,ভ্যাম্পায়ার এই সব ভৌতিক রহস্য আমরা বিভিন্ন বইতে পড়ে আসছি। কিন্তু মানুষের কল্পনা শক্তি কতটা প্রখর হলে সেই কল্পনা “আরব্য রজনী”র মতো কল্পনা যা মানুষকে জীবন্ত ও প্রাণদীপ্ত করে তুলতে পারে তার ইতিহাস আমরা সকলে জানি। এই সব ইতিহাস আমরা বিভিন্ন বইতে শুনে আসছি। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন কি কেউ হয়েছেন? সেই পরিস্থিতি কলমকে ও কাঁপিয়ে তোলে। আজ সেই রকম একটা ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছি। সালটা ছিল ১৯৯৭, ২৪শে জানুয়ারি। শীতটাও জাকিয়ে পড়েছে এবারে। সেদিন অভিরাম অফিসে খাতাপত্রের কাজ সেরে অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে ঘড়িতে তখন প্রায় সন্ধ্যা পৌনে আটটা বাজতে চললো। অভিরাম সেদিন অফিসের দারুয়ান শ্যামচরণকে অফিসের চাবিটা দিয়ে, সাইকেল নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। রাস্তাঘাট চারিদিকে যেন আজ শুনশান লাগছে। আজকের রাতটা যেন বেশি অন্ধকার লাগছে অভিরামের কাছে,চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। সাইকেলের প্যাডেল করতে করতে কিড়িং কিড়িং শব্দে এগিয়ে চলেছে অভিরাম সাইকেল নিয়ে। রাস্তার দুই পাশে তাল ও ঝাউ গাছের সারি। এই অন্ধকারে তালগাছ গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে.....
“শতাব্দীর রাক্ষসগুলো বুক চিতিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। ঠান্ডা বাতাসের হাল্কা হাওয়া বার বার শরীরটাকে কাঁপিয়ে তুলছে”! - অভিরাম দ্রুত গতিতে সাইকেল চালাতে থাকলো কিছুটা দূরে শ্মশান। তার পাশ দিয়ে অভিরাম যেই একটু জোরে সাইকেলের প্যাডেল করতে যাবে হঠাৎ “সাইকেলের টায়ার গেলো ফেটে” অভিরাম সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলের টায়ারের দিকে চোখ যেতেই তিনি বুঝতে পারলেন “টায়ার গেছে ফেটে”।এখনো প্রায় তাকে আরো এক ঘন্টার পথ যেতে হবে। এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে সে একা একা এই ভাবে সাইকেল গড়িয়ে নিয়ে যাবে ভাবতে গায়ে শিহরণ দিয়ে উঠলো অভিরামের।এবার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। আশে পাশে কোন বাড়ি নেই। হঠাৎ শ্মশানের বটগাছের তলায় কাউকে দেখে অভিরাম চিৎকার করে বললো, “কে ওখানে?” অভিরাম রীতি মতো ভয় পেয়ে গেছে।আজ এই রকম বিপদের দিতে বন্ধু সমরেশ কে ভীষণ মনে পড়ছে। বেশ কিছুদিন অফিসে আসছে না। সে থাকলে দুজনের কোন সমস্যা হতো না। বটগাছের তলা থেকে একটা শব্দ শোনা গেলো। তিনি কিছুটা কাছে এলেন। অবিরাম প্রথমে দেখে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলো। সামনে আসতেই সবকিছু পরিস্কার হয়ে গেলো। তিনি একজন সাধু। তিনি অভিরাম কে বললো, “এতো রাতে এখানে কেন?। অভিরাম সাধু কে সবকথা বললো। সাধু প্রথমে শুনে একটু চুপ থাকলো। তার পর তিনি অট্টহাসিতে হাসতে লাগলো। অভিরাম সাধুর কথাগুলো প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি। কারণ এই আধুনিক সভ্যতায় এই রকম কুসংস্কার তিনি মানতে চান না। অভিরাম বিজ্ঞানের ছাত্র। বরাবর সে প্রমাণ ছাড়া কোন কিছু মানতে চায় না। সাধুকে ভন্ড বলে মনে হয়েছে অভিরামের। কিন্তু আজও কত তথ্য কুসংস্কারে পড়ে আছে যা সেগুলো গোপনতার আড়ালে সত্যমুখী করে তোলে। কিন্তু তার সম্মুখীন হওয়া মৃত্যুর সমান।....... “নিশুতি রাতের ডাকে অজানা দুটো চোখ বার বার শিকারির মতো তাকিয়ে আছে”।
-এদিকে তখন ঘড়িতে প্রায় নয়টা বাজতে চললো। কখন সে বাড়ি ফিরবে? এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। হঠাৎ অভিরাম সাধু বাবাকে ওখানে আর দেখতে পেলো না। এই টুকু সময়ের মধ্যে কোথায় গেলো? অভিরাম দুই বার সাধু বাবাকে ডাকলো কিন্তু কোন সাড়া নেই। এখন সত্যি অভিরামের ভয় আরো বেশি জাপটে বসেছে। হঠাৎ শ্মশান থেকে দুটো কালো বেড়াল চেঁচাতে চেঁচাতে ডান দিকের জঙ্গলে দিকে দৌঁড়ে পালিয়ে গেলো। অভিরামের মনে একটা প্রশ্ন জাগলো “এতোক্ষণ তার সঙ্গে যে কথা বলেছিল সে কে?” হঠাৎ জঙ্গলে হায়নার শব্দে অভিরামের শরীরে হাড় হিম করা ভয় বার বার ফুসফুস কে আঘাত করছে।নিঃশ্বাস এখন দীর্ঘশ্বাসে পরিনত হয়েছে। কিছুটা দূরে কেউ যেন বসে বসে কাঁদছে। অভিরামের মাথা ঠিক নেই। হঠাৎ এই জঙ্গলের মধ্যে কে কাঁদছে? তাল গাছের সারি দিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে সেই সাধুটাকে দেখতে পেলো।.....“হঠাৎ অভিরাম চমকে উঠলো। তার মাথায় এখন একটা চিন্তা এই ভূতুড়ে জাগয়া থেকে তাকে যেমন করে হোক বেরোতে হবে”! - সেই সাধু এখন একটা ভঙ্কর “অঘোরী” বেশে চিৎকার করে ডাকছে.- “আয় সারা জনমের তপস্যা। তোকে হত্যা করে আমি রক্ত পান করবো। “অঘোরী”র সে কি অট্টহাসি”! - জাদুশক্তির বলে অভিরাম নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। কিন্তু তার জ্ঞান ও হুঁশ আছে। জঙ্গলে একটা নিশুতি রাতের কান্না ভেসে আসছে বার বার। অভিরাম প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলো। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। “অঘোরী”র সামনে কত কঙ্কালসার মুন্ডুমালা পড়ে আছে। সামনে যোগ্যের অর্ঘ্য ডালা। “অঘোরী”র সামনে যে প্রদীপ টা জ্বলছে ওটাকে যেমন করেই হোক তাকে নেভাতে হবে। অভিরাম হাতের টর্চের লাইট দিয়ে সজোরে আলোর প্রদীপের দিকে ছুঁড়ে মারলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপ গেলো নিভে।...... “অঘোরীর সে কি হিংস্র চিৎকার!” সঙ্গে সঙ্গে অভিরাম জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড় মারলো প্রাণ পনে। তাল ও ঝাউ গাছের সারি দিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে একটা অবলা প্রাণীর মতো দৌড়াতে লাগলো। পেছনে নিশুতি রাতের কান্নার মতো একটা হিংস্র শব্দ চিৎকার করে বলছে......“আমার হাত থেকে শিকারী পালিয়ে গেলো। আ আ। ওকে ধরে আন এতো বছরের সাধনা বিফলে যাবে।” - সেদিন অভিরাম হাঁপাতে-হাঁপাতে নিজের বাড়ির সামনে চিৎকার করে ডাক দিয়ে জানশূন্য হয়ে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। বাড়ির দরজা খুলে অভিরামের স্ত্রী মণিমালা স্বামীকে জ্ঞানশূন্য অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে এলো।তার গা এখন গরমে পুড়ে যাচ্ছে। “সে বার বার ভয়ের একটা অতঙ্কে চিৎকার করছে আর কাঁপছে”! তারপর থেকে প্রায় দশদিন জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়লো। অভিরাম কাউকে ঠিক মতো চিনতে পারছেনা। সুস্থ হয়ে স্ত্রীর সামনে সবকিছু কিছু ঘটনা সবিস্তারে বললো। এই কথা শুনে অভিরামের স্ত্রী স্বামীকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct