পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে ড. সি ভি আনন্দ বোস কার্যভার গ্রহণ করেছেন। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। । সেই আবহে তেতে উঠেছে বাংলার রাজনীতি। রাজ্যপাল থাকাকালীন জগদীপ ধনখড় যেভাবে বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন। রাজ্যপালের অতি সক্রিয়তায় বহু বিশেষণে ভূষিত হয়েছে গরিমার পদটি। তিনি উপরাষ্ট্রপতি পদে চলে যাওয়ার পর অস্থায়ী রাজ্যপাল লা গণেশন ‘নিয়মতান্ত্রিক নীরবতা’ পালন করে গেলেন। রাজ্যপাল ও রাজ্যের সংঘাত এ নিয়ে লিখেছেন কাজী খায়রুল আনাম। আজ শেষ কিস্তি।
রাজ্যপাল বিরোধী আন্দোলন একসময় কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। অধুনা লুপ্ত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ফারুক আব্দুল্লাহ সরকার (১৯৮৩) সংখ্যালঘু হয়ে পড়লে, রাজ্যপাল জগমোহন ফারুকের ভগ্নিপতি গোলাম মোহাম্মদ শাহ্ কে সরকার গঠনের সুযোগ করে দেন। শাহ কংগ্রেসের সমর্থনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করেন। কিন্তু জ্যোতি বাবুর নেতৃত্বে অকংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীগণ সারাদেশে ইন্দিরার বিরুদ্ধে কনক্লেভ শুরু করেন। আন্দোলনে ঘৃতাহুতি পড়ে অখণ্ড অন্ধ্রপ্রদেশর রাজ্যপাল রামলাল নন্দমুরি তারক রামরাওয়ের টিডিপি দলের বিদ্রোহী নেতা ভাষ্কর রাওকে সরকার গড়তে দেন। কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার গড়ার বিরুদ্ধে বিরোধীরা জ্যোতি বাবুর নেতৃত্বে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হলে ইন্দিরা সংসদে বলেন, রাজ্যপাল রামলালজি আমাকে না জানিয়ে একাজ করেছেন। রামলালকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী পদে (১৯৮৪) বহাল হন রামরাও। কেন্দ্রের বর্তমান সরকার উত্তরাখণ্ডে হরিশ দাওয়াত এবং অরুনাচল প্রদেশে নাবাম টুকির সরকারকে ভাঙতে গিয়ে আদালতের রায়ে ব্যর্থ হয়। রাজ্যপালদের রাজ-কীর্তির বহু নজির ছড়িয়ে রয়েছে ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে। এবং প্রায় প্রত্যেকটি সরকার এই দূষ্কর্মে জড়িত বলে শোনা গেছে বিরোধী অভিযোগ। অথচ রাজ্যপাল নামক অরাজনৈতিক পদটিকে সাংবিধানিক মহিমা দান করা হয়েছিল রাজ্যে রাজ্যে নিরপেক্ষ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সূত্রধর হিসাবে। বাতিল রাজনীতিকদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু মহিমান্বিত রাজ্যপাল পদেও রাজনৈতিক আনুগত্যের ও কৃতজ্ঞতার বিষয়টি ভুলতে পারেন নি, অনেকেই। অভিযোগ শুধু আজকের নয়, অতীতেরও।
রাজ্যপাল পদেরও সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা আছে। আবার দায়িত্বও আছে। অহেতুক রাজনৈতিক উপদ্রব সৃষ্টি করে সমীহ আদায়ের প্রচেষ্টাটি গর্হিত বলে বিবেচনা আসছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ। সেও আজকের কথা নয়। ভারতবর্ষের যেকোন প্রান্তের রাজ্যপাল রাষ্ট্র সরকারের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে রাজ্যে আসেন। এবং তাঁর সেই ধন্য জ্ঞান রাজ্যপালের পদ মর্যাদা ও সাংবিধানিক গরিমা ক্ষুণ্ণ করে ।মজার ব্যাপার হল, যখন যে দল বিরোধী হয়ে পড়ে তারা তখন রাজ্যপাল পদের কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে করতে পারেন না। সেই দলই খেলা ভাঙার খেলায় রাজ্যপালকে এজেন্ট হিসাবে ব্যবহার করে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই বলা যায়, এখনও রাজ্যপাল পদের আবশ্যকতা আছে। কোনও রাজ্যে সরকারের স্বৈর প্রবণতা রুখতে রাজ্যপাল পদের, উপস্থিতি বিশেষভাবে দরকার আছে। অস্পষ্ট জনাদেশ, দলত্যাগের ফলে সাংবিধানিক সংকট নিরসনে রাজ্যপালের ভূমিকা বিশেষভাবে মাহাত্ম্যপূর্ণ। উচ্চ শিক্ষার অলিন্দে রাজনীতিকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবর্তে রাজ্যপালের আচার্য ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সর্বোপরি রাজ্যপাল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তথা কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের ব্যাপারে এক গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র নির্মাতা।
ভারতবর্ষের সংবিধানে রাজনীতির ওপরে নিরপেক্ষতাকে মর্যাদা দান করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল অথবা রাজ্যসভা, বিধান পরিষদ সেই নিরপেক্ষতার প্রতীক। ক্ষমতার শাসন সেই প্রতিকী মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে বহু পূর্বেই। রাজনীতির বাইরে থেকে সুশীল সমাজের বিদ্বজ্জন বা বুদ্ধিজীবীদের গণতান্ত্রিক শাসনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি সেভাবে। ফলে, বাতিল রাজনীতিকদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে নিরপেক্ষতার মূল কেন্দ্রগুলি। বস্তুত, পুরো ব্যবস্থাটাই চলে গেছে রাজনীতির দখলে। রাজনীতির এই দখল মুক্তির জন্য চাই, চেতনা সম্পন্ন নাগরিক সমাজ। যা ভারতবর্ষের বহু দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বহু বিভ্রান্তির মধ্যে চটজলদি সমাধান অসম্ভব। এরই প্রেক্ষিতে বলা যায়, রাজ্যপালদেরও রাজনীতির ঊর্ধ্বে অবস্থান অপ্রত্যাশিত। স্পষ্টত, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী বা শাসক দল ভদ্রতার অবস্থান বজায় রাখলেই আপাতত গণতন্ত্রের মান রক্ষা হবে। রাজ্যেরও মঙ্গল নিহিত রয়েছে সেই অবস্থানে। নতুন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের নিকট বঙ্গবাসীর প্রত্যাশা অনেক। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct