পথে হল দেখা
সনাতন পাল
এই যে মশাই, শুনছেন ! একটু চেপে বসুন, এখানে আমার সিট আছে। ”এই বলেই সুচরিতা ভদ্রলোককে সরিয়ে দিয়ে ট্রেনের সিটে বসল। সে পুজোর ছুটি কাটাতে ব্যাঙ্গালোর থেকে হরিদেবপুরে নিজের বাড়িতে আসছে। ওখানে জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করে। পাশের ভদ্রলোক মাথা নিচু করে এক মনে খবরের কাগজ পড়ছে। সুচরিতা মনে মনে ভাবছে, “এ কি রে, বাবা- আমার মতো একটা অল্প বয়সি সুন্দরী দেখেও যেচে খাতির করতে আসছে না!” অবশেষে নিজেই ভদ্র লোককে বলল-- এই যে মশাই, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? - আজ্ঞে, কি বললেন? - বলছি,কোথায় যাচ্ছেন ? - আজ্ঞে, কলকাতায়।- ওখানে কি বেড়াতে যাচ্ছেন? - না না, কলকাতায় আমার বাড়ী। এরমধ্যে ট্রেনে চা ওয়ালা ওঠে হাক পাড়ছে-” চা চাই, চা- একদম গরমাগরম চা ।” সুচরিতা ভদ্র লোককে বলল-- চা খাবেন ? - আজ্ঞে, একটু খেতে পারলে বেশ ভালোই হতো। কিন্তু কাছে যেটুকু পয়সা আছে, খরচ করলে আহিরিটোলায় যাওয়ার ভাড়া থাকবে না। - পয়সার কথা আপনাকে কে জিজ্ঞেস করেছে? আমি তো জিজ্ঞেস করেছি,চা খাবেন কি না। পয়সা তো আমি দেবো। - কিন্তু আপনি আমাকে শুধু শুধু চা খাওয়াবেন কেন? - কেন! খাওয়াতে পারি না ? - আমি খেলে তবেই পারবেন। কিন্তু কেন? - আপনি আমার বন্ধু বলে। - বন্ধু! - হ্যাঁ, বন্ধু। আপনাকে আমি মনে মনে বন্ধু বলে ভেবে নিয়েছি। এতে আপনার কোনো আপত্তি থাকলেও শুনবো না।- জোর করছেন? - যদি বলি হ্যাঁ, তাহলে কি ফাঁসি দেবেন নাকি? - না না,তা কেন ? এমন ভাবে বলবেন না,প্লিজ। - তাহলে চুপচাপ চা খান। এই বলেই চা ওয়ালাকে সে বলল- দুটো চা দিন। চা দিল। দুজনেই বসে বসে চা খাচ্ছে। হঠাৎ করেই সুচরিতা, ভদ্রলোককে বলল- এই দেখেছেন! আপনার নামটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। - আজ্ঞে,অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি। - কি করা হয় ? - আজ্ঞে, টিউশনি পড়াই। - বাড়ীতে কে কে আছেন? - বাবা, মা, এক বোন। - বাবা কি করেন ? - অবসর প্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক। - চাকরি পেলে করবেন? - নিশ্চয়ই করবো। কিন্তু আমাকে কে দেবে চাকুরি?
- লেখাপড়া কতটা করা হয়েছে? - এম এ পাশ । - আরে মশাই, করেছেন কি ! এম এ পাশ করে ঘাপটি মেরে বসে আছেন! আর আমি বুঝতেই পারিনি ! আমাদের দূর্গাপুরের স্টিলের কারখানায় সেলস ম্যানেজার পোস্টে কাজ করবেন? যদি করেন,তাহলে বাবাকে বলে দেখতে পারি। - এমন চাকুরি কেউ কখনও হাতছাড়া করে! নিশ্চয়ই করবো। অনিরুদ্ধর চাকুরি হলো। সুচরিতার বাড়ী থেকে দেখা করার জন্য মাঝে মাঝেই তার কাছে ডাক আসতে শুরু করল। রীতিমতো যাওয়া আসার ঘনঘটা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল। বাবা জেনেও কিছু আপত্তি করলেন না। তিনি একদিন মেয়েকে বললেন-- এবার চারহাত এক করার বন্দোবস্ত করে ফেলি রে, মা ? শুনে মেয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। বাবা বুঝলেন,মেয়ে রাজি আছে।বিয়ের দিন ঠিক হলো। বিয়ে করতে আসার সময় হঠাৎ দুর্ঘটনায় অনিরুদ্ধর ডান হাতটা কাটা পড়ল। খবর পেয়ে সুচরিতা নিজেই গাড়ী ড্রাইভ করে হাসপাতালে গেল এবং বাবার নিষেধ উপেক্ষা করেই ঐ অবস্থায় হাসপাতালে লগ্ন পার না হতেই অনিরুদ্ধ কে বিয়ে করল। মেয়ে একবারের জন্যও ভবিষ্যতের কথা ভাবল না। সে ভাবল বিয়ের পরেও এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। বিয়ে করে সোজা গিয়ে স্বামীর ভিটেতে উঠল। বাবা বললেন- আমার ওখানেই থাক, মা। স্বামীর বাড়িতে কষ্ট হবে। এখানে সব মানিয়ে নিতে পারবি না। বাবার সমস্ত অনুরোধ উপেক্ষা করে উত্তরে সে বলল-- বিয়ের পর যে মেয়েদের স্বামীর ঘরই নিজের ঘর ,বাবা। আমি এখানেই ভালো থাকবো। তুমি আমার জন্য একদম চিন্তা করো না, কোনো সমস্যা হবে না। বৌমার মুখে একথা শুনে শ্বশুরমশাই বললেন--- বৌমা ঠিক কথাই বলেছে। আর আমরা তো সকলেই রয়েছি, কোনো অসুবিধা হবে না। আপনি নিঃশ্চিন্তে থাকতে পারেন, বিয়াই মশাই। বৌমা আমাদের মেয়ের মতো, আমরা ওর সব খেয়াল রাখবো- অনিরুদ্ধর মা বিমলা দেবীর মুখে একথা শুনে কন্যা দায় গ্রস্ত পিতা অনেকটা আশ্বস্ত হলেন।
কিছুদিন পরে অনিরুদ্ধ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরল। ঔষধের মোটা খরচ প্রতি মাসে টানা ভীষণ কষ্টের। সে বাড়ীতে আরও দুটো টিউশনির ব্যাচ বারিয়ে নিল। তবুও যেন অভাব তাদের পিছু ছাড়ছে না। এদিকে বাবা অবসরের সময় যেটুকু টাকা- পয়সা পেয়েছিলেন,তা এম.আই.এস করে ব্যাঙ্কে রাখা আছে। সে টাকার আবার সুদ কমে গিয়েছে। তাই সুদ বাবদ আগের মতো আর মাসিক টাকা তিনি পান না। ইতিমধ্যে শাশুড়ি মুখ খুলে দিয়েছে। একদিন কথা কাটাকাটি হতেই বৌমাকে রাগের বসে বলে বসল-- তোমার জন্যই তো আমার ছেলের আজ এই দশা। যদি তোমার সাথে বিয়ে ঠিক না হতো তাহলে এমন দুর্ঘটনা হয়তো ঘটতই না। তোমার মতো লক্ষ্মী ছাড়া মেয়ে আর দুটো দেখিনি,বাপু। সংসার টাকে একদম জ্বালিয়ে দিলে ! এই কথা শুনে সুচরিতা চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না। কিন্তু এমন গঞ্জনা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। একদিন দিশে না পেয়ে ছেলে, তার মাকে বলল- আচ্ছা, মা এমনটা যদি তোমার নিজের মেয়ের সাথে ঘটত,তাহলে কি করতে? - তখনকার কথা তখন ভাবতাম। বৌয়ের হয়ে খুব যে ওকালতি করা হচ্ছে! - না না তা কেন ! যেটা ন্যায্য সেটাই বলছি। - ওরে বাবা,ধর্মপত্তুর যুধিষ্ঠির নাকি ? - না, তবে তুমি রীতিমতো সুচরিতার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো। - এখন তো তা বলবেই, বিয়ে করেছো, বৌ হয়েছে- মা হয়েছে এখন শত্তুর। - ছিঃ মা, এমন ভাবে বলছো কেন ? - কি ! এতো বড় কতা ? বলেই কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে গিয়ে মা বললেন- এতো অপমান ! তুমি এর একটা বিহিত করো, না হলে আমি বাড়ি থাকবো না। বাবা শুনে বললেন- ঠিক আছে দেখছি। বলেই সোজা অনিরুদ্ধ কে গিয়ে বাবা বললেন- তোমাদের এখানে থাকতে অসুবিধা হলে অন্য কোথাও থাকার জায়গা দেখে নিতে পারো। শুনে ছেলে অবাক হয়ে বাবাকে বলল-
বাবা, তুমি কি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছো? - যদি ভাবো তাই,তাহলে তাই। - ঠিক আছে, সাতটা দিন সময় দাও। - সময় যত কম নেবে ততই মঙ্গল। বাবা- ছেলের এই কথা শোনার পরে সুচরিতা কাঁদতে কাঁদতে স্বামী কে বলল- -চলো, আমরা ভাড়া বাড়িতেই চলে যাই। -সে না হয় যাবো, কিন্তু একদিকে সংসার খরচ,অপর দিকে বাড়ি ভাড়ার বাড়তি খরচ জুটবে কি করে? - ও তুমি কিছু ভেবো না, ঠিক চলে যাবে। আমিও না হয় ছাত্র পড়াতে শুরু করবো। কিন্তু এতো অশান্তি আর সহ্য করা যাবে না। অবশেষে হাত কাটা স্বামীর হাত ধরে দুঃখিনী সুচরিতা ঘর ছাড়ল। লোক মুখে খবর পেয়ে বাবা এসেছেন মেয়ের খবর নিতে। সব জানার পরে মেয়ে জামাইকৈ ঘরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু মেয়ে বাবার প্রস্তাবে রাজি হলো না। অবশেষে হততাগা বাবা নিরাশ হয়ে ঘরে ফিরলেন। এভাবেই তাদের দিন কাটতে লাগল। এর মধ্যে সুচরিতা আই এ এসের জন্য যে পরীক্ষা দিয়েছিল তার ফলাফল বের হয়েছে। সে আই এ এস হবার সুযোগ পেয়েছে। খুব কষ্ট করে ট্রেনিং শেষ হলো। ফলাফলের বিচারে সে প্রথম হয়েছে। সরকার থেকে জানতে চাওয়া হলো যে সে কি চায় ? সে বলল- নিজের জেলাতে পোস্টিং চাই। তারপরে তাঁকে নিজের জেলাতেই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিসেট্রট করা হলো। প্রথম দিন অফিসে যাবার আগে শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করতে গেল। শাশুড়ির ব্যবহার একদম পরিবর্তন। পায়ে হাত দিয়ে শাশুড়িকে প্রণাম করতেই বললেন- বড্ড ভুল করেছি বৌমা, ক্ষমা করে দাও। তুমি আমাদের বাড়িতেই এক সঙ্গে থাকো,মা। সুচরিতা বলল- আপনারাই আমাদের কাছে চলুন,সব দায়িত্ব আমার। শেষে বুড়ো-বুড়ি দুজনেই ছেলে-বৌয়ের কাছে চলে গেলেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct