মালয়েশিয়ার এবারের নির্বাচন বেশ জটিল এক সমীকরণের দিকে এগোচ্ছে। আগেরবারের নির্বাচনে যেখানে উপদ্বীপ মালয়েশিয়ায় অনেকটাই দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল, সেখানে এবার সর্বত্র ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর দুই সপ্তাহ পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে; তার জন্য প্রাক-নির্বাচন মেরুকরণ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই মেরুকরণের শেষে তিন প্রধান জোট তাদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করেছে। এরপর নির্বাচন পর্যন্ত কিছু বোঝাপড়ার অবকাশ থাকতে পারে। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
মালয়েশিয়ার দু’টি অংশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের মতো আসন হল উপদ্বীপ মালয়েশিয়ায়। বাকিটা সাবাহ ও সারওয়াক নিয়ে গঠিত বর্ণিও মালয়েশিয়ায়। দেশটির দুই অংশের রাজনীতির ধারার মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে। বর্নিও মালয়েশিয়ায় দেশটির মূল অংশের বড় দলগুলোর প্রভাব একবারে কম। কয়েক দশক ধরে সারওয়াকে সরকার গঠন করে আসছে স্থানীয় দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট। সাবাহতে একসময় আমনুর শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও সেখানে এখন শক্ত অবস্থানে চলে এসেছে স্থানীয় দলগুলো। বর্নিও মালয়েশিয়ায় যে এক-তৃতীয়াংশের মতো আসন রয়েছে তাতে যারা প্রাধান্য বিস্তার করবে তারা ফেডারেল সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পাকাতান হারাপানের বিলুপ্ত সংসদে ১০৪ সদস্যের সমর্থন ছিল। সারওয়াকের জিপিএস এর সমর্থন পেলে এ জোটের পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হতে পারতো। জোটের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের সামনে বর্নিও মালয়েশিয়ার দলগুলোকে সাথে নিয়ে জোট গঠনের লক্ষ্য থাকতে পারে। তিনি সেখান থেকে একজন উপপ্রধানমন্ত্রী করার কথাও এর মধ্যে বলেছেন। অন্য দিকে, একটি পক্ষ বারিসান ন্যাশনাল ও পেরিকাতান ন্যাশনালের সাথে নির্বাচনের আগেই সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন। সেটি ড. আহমদ জাহিদ হামিদের সাথে মহিউদ্দিন ইয়াসিনের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। নির্বাচনের পর ফলাফল স্পষ্ট হয়ে গেলে এ দুই জোটের মধ্যে আবারো কোয়ালিশন গঠনের চেষ্টা হতে পারে। পেরিকাতান ন্যাশনালের মধ্যে এখন বড় দলই হল পাস। পাসের প্রধান আবদুল হাদি আওয়াং কোনোভাবে আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চান না। যার কারণে তিনি পাকাতান হারাপান সরকারের পতনে শেরাটন মুভের সূচনা করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। আবার পাসের একটি অংশ আমনুর সাথে সরকার গঠনে আগ্রহী নয়। চিন্তাভাবনার এ বিভাজনের একটি প্রভাবও নির্বাচনোত্তর সরকার গঠনে পড়তে পারে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এখন পাকাতান হারাপানের প্রার্থী হলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। বারিসান ন্যাশনাল জোটের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন সেটি এখনো ঘোষণা করা হয়নি। তবে আহমদ জাহিদ হামিদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পেরিকাতানের প্রধানমন্ত্রী হবেন মহিউদ্দিন ইয়াসিন। যদিও এ জোটের আসন ৩০ পার হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের। ফলে আগামীতে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দুই শক্তিমান প্রার্থী হতে পারেন আনোয়ার ইব্রাহিম ও আহমদ জাহিদ হামিদ।
গভীর ক্ষমতাবলয়ই মুখ্য মালয়েশিয়ার অর্থনীতির ওপর ২৫ শতাংশ চীনা বংশোদ্ভূতদের একতরফা প্রভাব রয়েছে। বলা হয় অর্থনীতির ৭০ ভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে। অন্য দিকে দেশটির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ৬২ শতাংশ মালয়রা, যাদের শত ভাগ মুসলিম। মালয়েশিয়ার ১৩ প্রদেশের সুলতান এবং রাজা এ গভীর ক্ষমতা বলয়ের মূল স্তম্ভ। পাকাতান হারাপানের সরকার পতনে তাদের ইচ্ছার একটি ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। গভীর ক্ষমতাবলয়ের অনেকের ধারণা আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী হলে চীনা প্রধান ডিএপির প্রভাব বাড়বে, যদিও দলটি এবার ৫০টির মতো আসনে প্রার্থী দিচ্ছে। আর এবার আনোয়ারের প্রতি গভীর ক্ষমতা বলয়ের সমর্থন কিছুটা বাড়ছে বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে জহুরের সুলতান বেশ প্রভাব রাখেন এ বলয়ে। শেষ পর্যন্ত যদি পাকাতান হারাপান বেশি আসনে জয়ীও হয়; তারপরও সুলতানরা আনোয়ারকে ক্ষমতায় দেখতে না চাইলে নতুন কোয়ালিশনে গভীর ক্ষমতা বলয় প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তিনি আবারো ক্ষমতার কাছাকাছি এসে ছিটকে পড়তে পারেন। আর জাহিদ হামিদের সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। মালয়েশিয়ার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে অভ্যন্তরীণ প্রভাবের পাশাপাশি বাইরের প্রভাবও সক্রিয় থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের ব্রাদারহুডবিরোধী রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলো সবসময় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ব্রাদারহুড ঘরানার দলগুলোর শক্তিশালী অবস্থান প্রতিহত করার চেষ্টা করে। পাকাতানের সরকার ভেঙে পড়ার পেছনে নেপথ্যে এ শক্তির ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। এবারের নির্বাচনেও শক্তিটির ভূমিকা থাকতে পারে। এছাড়া বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে দুই প্রধান পক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা থাকে মালয়েশিয়ার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবও কমবেশি পড়তে পারে। পরোক্ষভাবে সিঙ্গাপুরও মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার নির্বাচনে ফল কি হবে তার ওপর পরবর্তী দুই সপ্তাহের প্রভাব থাকবে নিঃসন্দেহে। তবে মূল খেলা শুরু হবে নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর। উত্তেজনাপূর্ণ বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাইরের প্রভাবশালী পক্ষগুলো আগের চেয়ে আরো বেশি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে মালয়েশিয়ার ওপর। (সমাপ্ত)......
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct