সুন্দরবন যেমন পরিবেশগত দুর্যোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট বিস্তীর্ণ এলাকাকে রক্ষা করে চলেছে, তেমনি জলবায়ুগত ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে সুন্দরবনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সুন্দরবন মানেই অগণিত ম্যানগ্রোভ গাছপালা, হরেক রকম কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি, পশুপাখি এবং সরীসৃপ সমৃদ্ধ এক অজানা জঙ্গলমহল। সুন্দরবন মানেই নোনা জল, কাদামাটিতে ঘন হয়ে থাকা হেতাল, সুন্দরী, কেওড়া, গরান, চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ব-দ্বীপের সমারোহ। সেসব নিয়ে লিখেছেন সজল মজুমদার।
পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্রের আধার বা আঁতুড়ঘর হল সুন্দরবন। এটি বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, যা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। সুন্দরবন যেমন পরিবেশগত দুর্যোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট বিস্তীর্ণ এলাকাকে রক্ষা করে চলেছে, তেমনি জলবায়ুগত ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে সুন্দরবনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সুন্দরবন মানেই অগণিত ম্যানগ্রোভ গাছপালা, হরেক রকম কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি, পশুপাখি এবং সরীসৃপ সমৃদ্ধ এক অজানা জঙ্গলমহল। সুন্দরবন মানেই নোনা জল, কাদামাটিতে ঘন হয়ে থাকা হেতাল, সুন্দরী, কেওড়া, গর্জন, বাইন, গরান, ছোটো বড় নদী, খারি, চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ব দ্বীপের সমারোহ। ৪২৬৪ বর্গ কিমি জুড়ে এই অঞ্চলের বিস্তার। সুন্দরবনের মোট ১০২ টি দ্বীপের মধ্যে ৫৪ টিতে মানুষ বসবাস করে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এখানে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪.৩ মিলিয়ন। মূলত সুন্দরবন বলতে প্রথমেই ম্যান গ্রোভ এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথাই সকলের মনে হতে পারে, কিন্তু এর পাশাপাশি সুন্দরবনের অধিকাংশ স্থান জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ প্রাণী যেমন বন বিড়াল, চিতল হরিণ, বিষাক্ত সাপ, কচ্ছপ, গন্ধগোকুল, বানর, গোখরো, এবং অবশ্যই ভয়ঙ্কর হিংস্র নোনা জলের কুমির। এই ধরনের কুমির সাধারণত লম্বায় ১৫-৩০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ওজনে ৩০০-৪৫০ কেজি বিশিষ্ট হয়। সাধারণত কালো বা হলদে রংয়ের হয়ে থাকে। ঊনবিংশ শতকের আগে সুন্দরবনে প্রধানত তিন ধরনের কুমির যথাক্রমে জলাভূমির কুমির, ঘড়িয়াল, খারী বা মোহনার কুমীরের, (crocodilus porosus) দেখা পাওয়া গেলেও বর্তমানে খারি বা মোহনার কুমিরের আধিক্যই লক্ষ্য করা যায়। এই ধরনের কুমির সাধারণত ভেটকি,পাঙ্গাস,দাতিনা, প্রভৃতি মাছ ও স্থলভাগে সুবিধা মতো বন মোরগ, হরিণ,বানর, প্রভৃতি প্রাণীও শিকার করে। বাঘের পাশাপাশি খাড়ির কুমিরের সঙ্গে নিত্য সংঘাত সুন্দরবনের অধিবাসীদের দৈনন্দিন সংগ্রামের অঙ্গ বললেই চলে। সম্প্রতি প্রকাশিত WWF এর তথ্য অনুযায়ী সুন্দরবনে প্রতিদিন প্রায় ৪-৫ জন মানুষ এই কুমির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। সুন্দরবনের কুমিরের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি নিয়ে কথা হচ্ছিল এখানকার ভূমিপুত্র ম্যানগ্রোভ ম্যান উমাশঙ্কর মন্ডলের সাথে। তিনি জানান -” সুন্দরবনে খাদ্যখাদকের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে কুমিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এখানে কুমিরের সংখ্যা বর্তমানে পর্যাপ্ত পরিমাণও রয়েছে। এখানকার বকখালির দিকে ভগবত পুরে সরকারি উদ্যোগে কুমির প্রজনন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। তবে সুন্দরবন ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্থান যেমন মেকং, হংকং, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি যেসব জায়গায় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ রয়েছে সেখানে সাধারণত বিনুনি আকৃতি জননির্গম প্রণালী দেখা যাওয়ার ফলে সেখানে উপস্থিত জলজ প্রাণীগুলোও ঐ পরিবেশের সাথে নিজেকে অভিযোজিত করে থাকে, যার জন্য সুন্দরবনের নোনা জলের কুমির অন্য প্রজাতির কুমীরের থেকে বৈশিষ্ট্য অনেকটাই আলাদা”। অপরদিকে সুন্দরবনের নোনা জলের কুমিরের বিষয়ে বিশিষ্ট বন্যপ্রাণ বিদ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য বন পাল ড: প্রণবেশ সান্যাল এই বিষয়ে বিশদে জানালেন।তিনি বললেন - “ মিষ্টি জলের কুমিরের চেয়ে নোনা জলের কুমিরের আকার, আয়তনে প্রায় দ্বিগুণ হয় (৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা) এবং এরা অত্যন্ত হিংস্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সুন্দরবনের এরকম একখানি কুমীর সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এছাড়া এই ধরনের কুমির যে ধরনের মাছ খায় ,সেই মাছগুলো নাকি পার্শে প্রজাতির মাছ গুলোকে খেয়ে থাকে,ফলে কুমীর সেই মাছগুলো খাওয়ার ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্রের স্থিতাবস্থা বজায় রয়েছে। সুন্দরবনের জেলেদের কাছে এই কারণেই কুমিরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সম্প্রতি ক্রকো ডাইল সেন্সাস এর তথ্য অনুযায়ী সুন্দরবনে এই সময়ে কুমিরের সংখ্যা ২০০ মতো রয়েছে”। সুতরাং জীববৈচিত্র্যময় সুন্দরবনে কুমিরের যে গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে একথা হরফ করে বলা যায়।
লেখক শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct