পরিবেশ বাঁচাতে এসো সাইকেল চড়ি
তুহিন সাজ্জাদ সেখ
বিজ্ঞানের দৌলতে আমাদের সভ্যতা অতিযান্ত্রিক। “অতিযান্ত্রিক” শব্দ টি ঠিক ভালো না মন্দ অর্থাৎ উপকারী না অপকারী সেটা ঠাহর করতে প্রায়শই বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়। এই শব্দটির সাথে যখন “যুগান্তকারী”, “দ্রুততর”, “অসাধ্যসাধন”, “কষ্টলাঘব”, “অভিষ্ঠিত লক্ষভেদ” ইত্যাদি শব্দ গুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তখন মনে হয় এটি বোধহয় বিজ্ঞানের আশীর্বাদ। আবার যখন “অতিযান্ত্রিক” এর সাথে “অনিয়ন্ত্রিত”, “অপব্যয়”, “অশৃঙ্খল” ,”অনাচার”, “আলস্য”, “পঙ্গুত্ব”, “পরিবেশ দূষণ” ইত্যাদি শব্দ গুলো জুড়ে যায় তখন মনে হয় এটি আসলে বিজ্ঞানের অভিশাপ। কাঠকয়লার ইঞ্জিন থেকে আজকের আধুনিকতর মোটরগাড়ি সবই বিজ্ঞানের দান— কিন্তু কিভাবে এই আধুনিকতর প্রযুক্তি হঠাৎ করে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করে বসছে সেটা ভাবলেই অবাক লাগে। তবে “পরিমিত” বিশেষণ টি এই যুগের সাথে আজ আর ঠিক মানানসই নয়; কেননা আজ সকল বিশেষ্যই “অতিরিক্ত”, “অপরিমিত”, “অসীমিত”, “প্রাচুর্যে” অভিহিত। ঠিক তেমনি আজকের যন্ত্র সভ্যতা “অতিযান্ত্রিক” । ঠিক যেমন পায়ে চালানো বাইসাইকেল ছেড়ে পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক পরিমাণে মোটরগাড়ির ব্যবহার আজ পরিবেশ দূষণের মূখ্য কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই হটকেক মোটরগাড়ি নিঃসৃত ধোঁয়া পরিবেশ দূষণের জন্য এককভাবেই ৩০-৪০ শতাংশ দায়ী, আবার শহরাঞ্চলে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০-৯০ শতাংশ। পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী কার্বন-মনো-অক্সাইডের অধিকাংশ টাই আসে এই যন্ত্রচালিত গাড়ির ধোঁয়া থেকে। এছাড়াও এই ধোঁয়া থেকে বের হয় ক্ষতিকারক জৈবিক পদার্থ, নাইট্রোজেন অক্সাইড, “পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫” ও অন্যান্য গ্রীণ হাউস গ্যাস যা পুরোদমে আমাদের পরিবেশে “বিশ্ব উষ্ণায়ন” ঘটিয়ে চলেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে এই যানবাহন নির্গত ধোঁয়া থেকে বার্ষিক প্রায় ২৯০ গিগাগ্রাম পরিমাণ “পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫” পরিবেশে মেশে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ মোটরগাড়ির বিক্রি আনুমানিক তিনগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক — সাম্প্রতিক ৩.৫ মিলিয়ন থেকে সংখ্যাটি হয়ে যাবে প্রায় ১০.৫ মিলিয়ন। এই ঘটনা পরিবেশ দূষণের মাত্রা নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দেবে। ভারতবর্ষ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারক হিসেবে উপনীত হয়েছে এই খবরটি যতটাই অর্থনৈতিক দিক থেকে আনন্দের তেমনই পরিবেশগত দিক থেকে দুঃশ্চিন্তার!
এসব কথা মাথায় রেখেই বলা যায় পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ব্যাপক মোটরগাড়ির ব্যবহার কমিয়ে বাইসাইকেলের ব্যবহার সমীচীন। বাইসাইকেল নিঃসন্দেহে একটি পরিবেশ বান্ধব যাতায়াতের মাধ্যম। সম্পূর্ণ মনুষ্য চালিত বাইসাইকেলের ব্যবহারের চেয়ে আজকের নয়া প্রযুক্তির মোটরগাড়ির রমরমা আমাদের বহু দ্রুত-চাহিদা এবং নিপাট সৌখিনতার রসনা কে পরিতৃপ্ত করলেও আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের এবং আমাদের নিজেদের স্বাস্থের চূড়ান্ত বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। মোটরগাড়ির তুলনায় বাইসাইকেল আজও একটি সহজ,সুলভ এবং সাশ্রয়ী পরিবহন মাধ্যম; তার উপর এটি অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব। তাই আজকের এই একবিংশ শতাব্দীর চূড়ান্ত অগ্রগতির বাজারে আমাদের স্বাস্থ্য, অর্থ এবং পরিবেশের স্বার্থে, বাইসাইকেলের ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে ৩রা জুন সারা বিশ্বে পালিত হয় “বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস”। শোনা যায় “আন্তর্জাতিক বাইসাইকেল তহবিল” -এর তথ্য অনুসারে ১৪১৮ খ্রীষ্টাব্দে জিওভানি ফন্টানা নামে একজন ইতালীয় যন্ত্রবিদ্যা বিশারদ চার চাকা বিশিষ্ট এক ধরনের বাইসাইকেল প্রস্তুত করেন। এই বাইসাইকেল টির মধ্যে দড়ি দিয়ে একটি ফাঁস তৈরি করে তার মধ্যে গিয়ার দেওয়া থাকত। এর প্রায় চারশো বছর পর,১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানির একজন অভিজাত আবিষ্কারক, নাম কার্ল ভন ডেইস তার নিজের মতো একটি “চলন্ত যন্ত্র” আবিষ্কার করেন। তিনিই ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে দুচাকার একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এটি সারা ইউরোপ জুড়ে কোথাও “ড্রেইজীন”, কোথাও “ড্যান্ডি হর্স” আবার কোথাও বা “হবি হর্স” নামে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তার এই আবিষ্কার ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ছিল। ঠিক ওই একই সময়কালে দানিস জনসন নামে একজন ব্রিটিশ গাড়ির কামরা প্রস্তুত কারক তার নিজের তৈরি সাইকেল বাজারে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ওটার নাম দিয়েছিলেন “পেডেস্ট্রিয়াম ক্যারিকলস”। তবে “ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আমেরিকান হিস্ট্রি”-র তথ্য অনুসারে ১৮২০ সালের পর এটির প্রচলন বন্ধ হয়ে যায়। এর পরে ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে একজন স্কটিশ কামার কির্ক প্যাট্রিক ম্যাকমিলান প্রথম যান্ত্রিক ভাবে চালিত বাইসাইকেল বাজারে নিয়ে আসেন; তিনিই আজকের আধুনিক বাইসাইকেলের আবিষ্কারক হিসেবে পরিচিত। তবে এখানেই শেষ নয়,এর পরেও নানা জন নানা ধাঁচের বাইসাইকেল প্রস্তুত করেন।এর পরে আবার ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে বাজারে নতুন করে বাইসাইকেল ফিরে আসে, সাথে স্টীলের চাকা, উন্নত পেডাল এবং স্থায়ী গিয়ার সিস্টেম।— নাম “ভেলসিপাইড” বা “বোনসেকার”। কিন্তু সমস্যা হল কে এই “ভেলসিপাইড” এর আবিষ্কারক? ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানির কার্ল কীচ দাবি করেন তিনিই প্রথম ওই উদ্ভাবনী পেডাল ও গিয়ার সিস্টেম চালু করেন। তবে মজার বিষয় হলো এই যে,”ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আমেরিকান হিস্ট্রি”-র তথ্য অনুসারে ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে বাইসাইকেলের প্রথম নমুনার অনুমোদন পেয়েছিলেন পিয়ারে লালেমন্ট, একজন ফরাশীয় বাহন প্রস্তুত কারক। তবে কার্ল কীচ কোন অনুমোদন পাননি।পরবর্তীতে বাইসাইকেলের আরও উন্নতি সাধন হয়েছিল।১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে মিনহক্স এবং অলিভার ভাইদের যৌথ প্রচেষ্টায় “ভেলসিপাইড” বাজারে বেশ হিট ছিল।”আন্তর্জাতিক বাইসাইকেল তহবিল”- এর তথ্য অনুসারে ১৮৭০ সালে বাইসাইকেল সহজ, হালকা এবং মজবুত পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ওই একই বছরে জন কেম্প স্টারলী তার “সেফটী বাইসাইকেল” নিয়ে বাজারে আসেন। তিনি ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটেনে “এরিয়াল” বাইসাইকেল,১৮৭৪ “ট্যান্জেন্ট স্পোক হুইল” এবং ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে “রোভার” বাইসাইকেলের প্রচলন করেন।
এভাবেই বাইসাইকেল মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে— সহজ, সুলভ, সাশ্রয়ী,ভরসা যোগ্য এবং সৌখিন প্রাথমিক পরিবহন মাধ্যম হিসেবে। সাইকেল চালানো মানুষের শরীর ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই ভালো। সাইকেল চালালে দৈহিক কসরতের সাথে সাথেই কোন রকমের দূষিত পদার্থ নির্গত হয় না ফলে পরিবেশে কোন দূষণও ঘটায় না। এটি একটি পরিবেশ বান্ধব যন্ত্র। বাইসাইকেল শুধুমাত্র পরিবহনের মাধ্যম হিসেবেই নয় এটি আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবেও বেশ উপযোগী।এটির সাহায্যে স্বাস্থ্য , শিক্ষা, খেলাধুলা, ছোট ব্যবসা বাণিজ্য,নাতি দীর্ঘ স্থানে আমদানি রপ্তানি, আত্মীয়ের খোঁজখবর নেওয়ার মতো পরিষেবা গুলো খুব সহজেই গ্রহণ করা যায়। এ প্রসঙ্গে “ইউরোপীয়ান সাইক্লিষ্ট ফেডারেশনে”র সাধারণ সম্পাদক ড. বার্নার্ড এনসিঙ্ক বলেন,” সাইকেল চালানো একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত উপকারের উৎস এবং এটি মানুষকে একত্রিত করে।” একজন সাইকেল আরোহী প্রতিটি মুহূর্তে তার স্থানীয় পরিবেশের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। সাইকেল চালানো আমাদের শরীরে হৃদ রোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়, স্থূলতা দূর করে, মধুমেহ রোগের ঝুকি কমায়, এবং আমাদের যৌন স্বাস্থ্য কে সতেজ করে। আমাদের ভারতবর্ষে বহু বিদ্যালয়ে সহজে শিক্ষা পরিষেবা গ্রহণ করতে ছাত্র ছাত্রীদের এবং আশাকর্মী দের প্রত্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় গর্ভবতী মা, প্রসুতি মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য পরিষেবা সুনিশ্চিত করতে সাইকেল প্রদান করা হয়েছে। আজ জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের বাজারে হটকেক মোটরগাড়ির চেয়ে সাইকেল অনেক অনেক বেশি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ বান্ধব। তাই আজ বাইসাইকেলের “অতিরিক্ত” ব্যবহার একান্ত কাম্য— এই সভ্যতার সুসংগত উন্নয়নের তাগিদে। —- আর এই তাগিদ সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছিলেন আমেরিকার একজন সমাজবিদ্যার অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট শারীরশিক্ষা কর্মী লেসেক সিবিস্কি। তিনি প্রথম ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই বিষয়ে “সাইকেল চালানো সবার কর্ম” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এই রচনা টি বেশ সাড়া ফেলেছিল এবং একটি আলোড়নের ধারা তৈরি হয়েছিল। অধ্যাপক সিবিস্কি বিষয়টিকে বেগ দিতে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্যে আরও একটি রচনা প্রস্তুত করেন— একটি “বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস” প্রতিষ্ঠা করার জন্য।এর পর স্বভাবতই আলোড়ন আরও ত্বরান্বিত হয়। ওই বছরই মার্চ মাসে তিনি তাইওয়ানের তাইপেই শহরে একটি বৈজ্ঞানিক সমাবেশে এই বিষয়ে যুক্তি প্রদর্শন করেন এবং তুর্কমেনিস্তান ও আরও ৫৬ টি দেশের সহযোগিতা লাভ করেন।এর ফলস্বরূপ ১২ই এপ্রিল ২০১৮ সালে রাষ্ট্র সঙ্ঘ ৩রা জুন কে “বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস” হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ওই বছরই ৩রা জুন রবিবার নিউইয়র্কে রাষ্ট্র সঙ্ঘের সাধারণ সভায় প্রথম “বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস” পালিত হয়।আইজ্যাক ফেল্ড, অধ্যাপক জন ই. স্বোয়ানসনের সহযোগিতায় একটি লোগো প্রস্তুত করেন যার মূল বার্তায় হল যে, বাইসাইকেল প্রত্যেকের এবং প্রত্যেকের জন্য। আজকে পাখির চোখ দিয়ে দেখলেও মহানগরীর বুকে গুটিকয়েক সাইকেলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও ক্ষতিকারক। তবে গ্রামে গঞ্জে এখনো সাইকেলের ব্যবহার হলেও আধুনিক প্রজন্মের সৌখিনতার খেসারত দিতে গিয়ে সাইকেলের জায়গায় মোটরগাড়ির ব্যবহারই বেশি হচ্ছে। ফলস্বরূপ গ্রামের পরিবেশও সমানভাবে দূষিত। তবে আমাদের মানসিক প্রচেষ্টা ও পরিবেশের প্রতি সচেতনতা আবার সাইকেল চড়ার গৌরবময় ইতিহাসকে ফুটিয়ে তুলতে পারে। সেই হেতু,মানুষের জীবনে সুসংগত সুস্থায়ী উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে বাইসাইকেলের ব্যবহারকে উৎসাহিত করতেই চেষ্টা চলছে সারা বিশ্ব জুড়ে।”ওয়ার্ল্ড বাইসাইকেল রিলিফস” এর প্রতিষ্ঠাতা এফ.কে. ডাই সত্যিই বলেছেন যে, একটি বাইসাইকেল হল একজন ব্যক্তির জীবনে একটি শৈল্পিক বিপ্লবের মতো। তাই এসো সাইকেল চড়ি, পরিবেশ বাঁচাই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct