নতুন করে করারোপের ফলে সমালোচনার মুখে অবশেষে সরে যান লিজ ট্রাস। এক্ষেত্রে ঋষি সুনাক দায়িত্ব নিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনিও দুটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—প্রথমত, কর হ্রাস করে জনমনে শান্তি আনবেন এবং দ্বিতীয়তি, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনবেন। এখন তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে তিনি কীভাবে বা কী জাদুর প্রয়োগ ঘটাবেন, যা লিজ ট্রাস পারেননি এবং তিনি পারবেন। লিজ ট্রাস যা করতে গিয়ে সরে গেছেন এবং তিনি টিকে থাকবেন, সেটা দেখার বিষয়। এ নিয়ে লিখেছেন ফরিদুল আলম। আজ শেষ কিস্তি।
বেক্সিট গণভোটে পরাজিত হওয়ার পর দলের ভেতরে একধরনের অসন্তোষের জেরে ২০১৬ সালে তিনি তার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। পরবর্তী সময়ে তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে এই পদে আসীন হলেও ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে দলের ভেতর অসন্তোষের জেরে তাকেও সরে যেতে হয়। দায়িত্বে আসেন সেই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন, যিনি একজন কট্টর ব্রেক্সিট সমর্থক। ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন ব্রিটেনের অর্থনীতিতে রীতিমতো একধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে এবং তিনি যত দ্রুত সম্ভব এটা কার্যকর করতে চান, বিষয়টি বুঝিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন আহ্বান করেন এবং এর সমর্থনে আগের চেয়েও আরো অধিকসংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়ে পুনরায় তিনি সরকার গঠন করেন। তার সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে। তখন থেকেই যেন সময়টা ভালো যাচ্ছিল না ব্রিটেনের।
২০১৯ সালের শেষ সময় থেকে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের বিস্তার এবং ২০২০ সালের শুরু থেকে ব্রিটেনসহ গোটা ইউরোপে এর ব্যাপকতা দেখা দিলে কয়েক মাসের লকডাউনে যেতে বাধ্য হয় গোটা ব্রিটেন। সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী ছিলেন আজকের ঋষি সুনাক। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একদিকে উৎপাদন থেমে যায়, সেই সঙ্গে কর্মীরা যখন আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছিলেন, এমন সময়ে জনসন সরকারের অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক ছয় মাসাধিককাল ধরে ৮০ শতাংশ হারে বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের বেতন দিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন। করোনা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মুদ্রাব্যবস্থায় সংকট এবং এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন করে ভাবিয়ে তোলে সরকারকে। দেশের সার্বিক অব্যবস্থাপনা এবং এগুলো নিয়ন্ত্রণে জনসনের উদাসীনতা, সেই সঙ্গে লকডাউনের বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে পার্টির আয়োজনকে ভালোভাবে নিতে পারেননি অনেক ব্রিটিশ এমপি, এমনকি অনেক নিজ দলের এমপি। অবস্থা বেগতিক দেখে আগেভাগেই পদত্যাগ করে বসেন ঋষি সুনাক। এখানে বলা হয়ে থাকে যে, ঋষি সুনাক রাজনীতিতে বয়সের তুলনায় অধিক পরিপক্বতার প্রমাণ দিতে পেরেছিলেন। যখন দেখলেন যে জনসন সরকারের অবস্থা টালমাটাল, সেই সময় থেকেই তিনি নিজেকে এই পদের জন্য সম্ভাব্য একজন হিসেবে তৈরি করতে থাকলেন। জনসন বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভালোভাবে নিতে পারেননি বলে লিজ ট্রাসের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার নেপথ্যে কলকাঠি নেড়ে তাকে পরাজিত করেন। সময়টি কিন্তু এখন ঋষি সুনাকের খুবই অনুকূলে, যার কারণে লিজের পদত্যাগের ঘোষণার পর ইতিপূর্বে তাকে সমর্থনদানকারীদের সমর্থন ধরে রাখতে পেরেছেন এবং সেই সঙ্গে সমর্থনের পদ্ধতিকে আরো ভারী করেছেন। এরই ফলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদ্বয় বরিস জনসন ও পেনি মরডান্ট শেষ মুহূর্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ালে তার জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের পথটি সুগম হয়।
নিয়ম অনুযায়ী ব্রিটেনে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৪ সালে এবং দলের মধ্যে নতুন করে গৃহদাহ সৃষ্টি না হলে সে পর্যন্ত কনজারভেটিভ পার্টির দলীয় নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন ঋষি সুনাক। তাকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যেতে হবে এই সময়ে। দেশের অর্থনীতি সচল করা এবং একই সঙ্গে কর হ্রাস করা তার জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। তিনি এই কাজ করতে গিয়ে প্রথম যে জায়গাটিতে হাত দেবেন বলে মনে হয়, সেটি হচ্ছে অভিবাসন খাত। ইতিপূর্বে লিজ ট্রাসের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় তিনি বলেছিলেন, অবৈধ অভিবাসন রোধে তিনি ‘রুয়ান্ডা নীতির’ বাস্তবায়ন করবেন। এই নীতির আওতায় অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাজ্য থেকে আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় স্থানান্তরের চেষ্টা করছে লন্ডন। একই সঙ্গে তিনি রুয়ান্ডার মতো আরো কিছু অংশীদার রাষ্ট্রকে খুঁজে বের করবেন, যেখানে এই নীতির সঠিক প্রয়োগ করা যায়। এক্ষেত্রে এশিয়ার কোনো কোনো দেশ, বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশসহ যেসব দেশ থেকে অভিবাসীরা অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন, তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে বাধ্য করতে পারেন। এখানে অশ্বেতাঙ্গ ও নন-ব্রিটিশ হিসেবে তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই অভিবাসন বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহে তার পূর্বসূরিদের চেয়েও বেশি কঠোর হবেন। তার ওপর যেন কোনো পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ না ওঠে, সে বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন থাকবেন বলে মনে হয়। নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর জন্য অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের শিকার ব্রিটেনকে নতুন করে টেনে ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে দলকে আগামী নির্বাচনের জন্য উপযোগী করে তোলারও দায়িত্ব রয়েছে। এক্ষেত্রে তার পূর্বসূরিরা যেভাবে এবং যে কৌশল প্রয়োগ করে সাধারণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, তাকেও এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে অর্থনীতি বিষয়ে সাম্যক জ্ঞান এই মুহূর্তে একজন প্রধানমন্ত্রীর জন্য বাড়তি পাওনা। যদিও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয় সামলাবেন না, এক্ষেত্রে যাকেই তিনি নতুন অর্থমন্ত্রী ও চ্যান্সেলর নিয়োগ দিন না কেন, উভয়ের সম্মিলিত প্রয়াস পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজে দিতে পারে।করেন। (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct