নতুন করে করারোপের ফলে সমালোচনার মুখে অবশেষে সরে যান লিজ ট্রাস। এক্ষেত্রে ঋষি সুনাক দায়িত্ব নিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনিও দুটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—প্রথমত, কর হ্রাস করে জনমনে শান্তি আনবেন এবং দ্বিতীয়তি, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনবেন। এখন তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে তিনি কীভাবে বা কী জাদুর প্রয়োগ ঘটাবেন, যা লিজ ট্রাস পারেননি এবং তিনি পারবেন। লিজ ট্রাস যা করতে গিয়ে সরে গেছেন এবং তিনি টিকে থাকবেন, সেটা দেখার বিষয়। এ নিয়ে লিখেছেন ফরিদুল আলম। আজ প্রথম কিস্তি।
তিনি কেবল বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, এই পদে আসীনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি কয়েকটি নজির স্থাপন করেছেন। বিগত শতাধিক বছরের মধ্যে ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ এবং এশিয়া থেকে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী তিনি। ঋষি সুনাকের পিতা-মাতার জন্ম ভারতের পাঞ্জাবে, পরবর্তী সময়ে আফ্রিকা হয়ে ব্রিটেনে বসতি স্থাপন করেন। পিতা-মাতা যথাক্রমে চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্ট হওয়ার কারণে পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল, যার ফলে তার শিক্ষার শুরুটা ভালো হয়। পরবর্তী সময়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি, দর্শন ও অর্থনীতি বিষয়ে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে কিছুদিন চাকরি করে পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ২০১৫ সালে উত্তর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার কাউন্টির রিচমন্ড এলাকা থেকে তিনি প্রথম বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। অল্প বয়সে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আরো দ্রুততার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে তিনি জেঁকে বসেন। এক বছরের মধ্যে তৎকালীন থেরেসা মে সরকারের মন্ত্রিসভায় জুনিয়র মন্ত্রী হিসেবে জায়গা করে নেন। থেরেসা পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে বিশেষ সখ্য এবং একই সঙ্গে ব্রেক্সিটপন্থি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকা এবং অর্থনীতিতে বিশেষ জ্ঞানের কারণে বরিস জনসন তাকে প্রথমে ২০১৯ সালে চিফ সেক্রেটারি এবং এর পরের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করেন। ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বরাবরই অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী—এরা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আস্থাভাজন হন এবং পাশাপাশি দলের ভেতরেও এদের একটা বিশেষ প্রভাব থাকে। সেদিক দিয়ে বলা চলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ক্ষমতার অনেকটা কাছে চলে আসেন।
করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ব্রিটেনকে বেশ কাবু করে ফেলেছে। বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর সেপ্টেম্বর মাসে দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনসন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসের কাছে পরাজিত হন ঋষি সুনাক। ধরে নেওয়া হয়েছিল, তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নের ইতি ঘটেছে। সেপ্টেম্বর লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হয়ে যেসব অর্থনৈতিক নীতি নেন, তাতে যুক্তরাজ্যের মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামলে নিতে না পেরে তিনিও বিদায় নেন। তার বিদায়ে এবং সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট অস্থিরতার মধ্যে যুক্তরাজ্যের হাল ধরার দায়িত্ব পড়ল ঋষি সুনাকের কাঁধে। লিজ ট্রাস সরকারের ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল কর হ্রাস করা, যার ফলে অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়, যার জেরে তার অর্থমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি তিনি। নতুন অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েই কর হ্রাসের সিদ্ধান্ত বাতিল করে আবারও নতুন করে করারোপের ফলে সমালোচনার মুখে অবশেষে সরে যান লিজ ট্রাস। এক্ষেত্রে ঋষি সুনাক দায়িত্ব নিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনিও দুটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—প্রথমত, কর হ্রাস করে জনমনে শান্তি আনবেন এবং দ্বিতীয়তি, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনবেন। এখন তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে তিনি কীভাবে বা কী জাদুর প্রয়োগ ঘটাবেন, যা লিজ ট্রাস পারেননি এবং তিনি পারবেন। লিজ ট্রাস যা করতে গিয়ে সরে গেছেন এবং তিনি টিকে থাকবেন, সেটা দেখার বিষয়। সামগ্রিক বিবেচনায় যা দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে, এই মুহূর্তে ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী বা তার সরকারের কাছে এমন কোনো ম্যাজিক নেই, যা দিয়ে ক্রমবর্ধমান সমস্যার লাগাম টেনে দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করে দেওয়া যায়। এখানে যে বিষয়টি মূলে কাজ করেছে সেটা হচ্ছে কনজারভেটিভ দলের ভেতর একধরনের নেতৃত্বের লড়াই। এই লড়াইয়ের শুরু একধরনের আস্থাহীনতা থেকে। ব্রেক্সিট ইস্যুকে কেন্দ্র করে ডেভিড ক্যামেরনের সরকারের পতনের পর থেকেই মূলত দলের ভেতরে এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ক্যামেরন ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন মর্মে ২০১৫ সালের নির্বাচনে আবারও কনজারভেটিভ দল আরো অধিকসংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct