ভারতবর্ষ খাদ্যে সয়ম্ভর একটি দেশ। অথচ, এই দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে দিন গুজরান করছেন। অন্যদিকে, সরকারি গুদামে পচে নষ্ট হচ্ছে টনটন খাদ্যশস্য। গনমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদন অনুসারে, প্রায় কুড়ি কোটি ভারতীয় অভুক্ত হয়ে প্রতিদিন ঘুমাতে যান। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’-এ, সেই করুণ সুর আবারও অনুরণিত হয়েছে। এ যেন প্রদীপের নীচে অন্ধকারের সহবাস। আলোকপাত করলেন ওহিদ রেহমান...
রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের ঈশ্বরী পাটনী কে আশাকরি সকলের মনে আছে। কূলবধূবেশী দেবী অন্নাপূর্ণা তাঁর নৌকার সেঁউতিতে পা রাখতেই, তা সোনা হয়ে যায়। অপত্য পিতৃস্নেহে গদগদ হয়ে, ঈশ্বরী পাটনী বর চেয়ে উচ্চারণ করে কালজয়ী শব্দবন্ধ - ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ এই আকুতি বিশ্বজনীন। দেশ, কাল, পাত্র ভেদে এই মমত্ববোধ আজও অটুট। তবে একথা বললে নিশ্চয়ই সত্যের অপলাপ হবে না যে, ঈশ্বরী পাটনীর সেই আকুতি আজও বাস্তবতার ভারতবর্ষে নোঙর করতে পারেনি। সম্প্রতি আয়ারল্যান্ড-ভিত্তিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এবং জার্মানভিত্তিক সংস্থা ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ কর্তৃক প্রকাশিত বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০২২ (Global Hunger Index)- এ এই অপ্রিয় সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন অনুসারে, আমার দেশ ভারতবর্ষ ১২১টি দেশে পরিচালিত এই সমীক্ষায় ১০৭তম স্থান লাভ করেছে। গতবছর প্রকাশিত এই তালিকায় আমাদের অবস্থান ছিল ১০২তম। অথচ, একসময় এই তালিকায় আমাদের দেশের অবস্থান ছিল পঞ্চাশের সারিতে। কিন্তু, বর্তমানে আমরা অবনমনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে চলেছি। ২০১৪ সাল পরবর্তী সময়ে সেমি-বুলেট চলা দেশে, এই অবনমন তরান্বিত হয়েছে নিঃসন্দেহে। এই মর্মে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তালিকায় আমাদের উপরে অবস্থান করছে নেপাল (৮১), বাংলাদেশ(৮৪), পাকিস্তান(৯৯) এমনকি সম্প্রতি অস্থিতিশীল শ্রীলঙ্কার(৬৪) মতো অধিকাংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
আসুন জেনে নিই, কিভাবে এই সূচক নির্ধারিত হয়ে থাকে। সাধারণত কয়েক’টি বিষয়ের উপর পর্যবেক্ষণ করে এই সূচক তৈরী করা হয়। সেগুলি হল - পুষ্টিহীনতা, ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার, ৫ বছর কম বয়সী শিশুদের ওজন এবং উচ্চতার তুলনায় কম ওজন (চাইল্ড ওয়েষ্টিং)। ক্ষুধা সূচকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের জনসংখ্যার ১৬.৩ শতাংশ মানুষ ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভুগছে। অন্যদিকে, ১৯.৩ শতাংশ শিশুর উচ্চতার অনুপাতে ওজন খুবই কম। আবার সমীক্ষায় দুটি সদার্থক বিষয় উঠে এসেছে, ২০১৪ সালে ভারতে শিশু স্টান্টিং (বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা)-এর হার ছিল ৩৮.৭ শতাংশ। ২০২২ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৫ শতাংশ, সেইসঙ্গে শিশুমৃত্যুর হার কমে হয়েছে ৩.৩ শতাংশ। যেখানে ২০১৪ সালে শিশু মৃত্যুহার ছিল ৪.৬ শতাংশ। সমীক্ষার সূচক অনুযায়ী কোনও দেশের স্কোর যদি ২০ থেকে ৩৪.৯ হয়, তাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে ধরা হয়। আবার স্কোর ৩৫ থেকে ৪৯.৯ হলে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে, কোন দেশের স্কোর ৫০-এর উপর হলে তা ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ গন্য করা হয়। সাম্প্রতিক প্রকাশিত এই তালিকায় ভারতবর্ষের স্কোর ২৯.১, ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী, তা ‘উদ্বেগজনক’। এই তালিকার একেবারে সর্বনিম্নে রয়েছে ইয়েমেন। তালিকার শীর্ষে রয়েছে মোট ১৭টি দেশ। সেখানে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রাধান্য রয়েছে। এশিয়া মহাদেশে থেকে তালিকার প্রথম সারিতে রয়েছে চিন এবং কুয়েত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের পরামর্শদাতা মিরিয়াম উইমার্স বলেছেন, “এই সমীক্ষায় কোন দেশে কী পরিমাণ অপুষ্টিতে, কত মানুষ ভুগছেন তাই দেখা হয়েছে। তার ভিত্তিতে ফুড ব্যালেন্স শিট তৈরি করা হয়েছে। ভারত সহ বিভিন্ন দেশ সরকারিভাবে রাষ্ট্রপুঞ্জকে যে পরিসংখ্যান প্রদান করেছে তাই এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।” অথচ ভারতবর্ষ খাদ্যে স্বয়ম্ভর একটি দেশ। মা ও শিশুর পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে সরকারের রয়েছে একাধিক সুসংহত প্রকল্প। অথচ তা সত্বেও ২০১৮ সালে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর নিরিখে আমরা প্রথম। সেইবছরে অকালপ্রয়াত হয়েছে প্রায় ৯ লক্ষ শিশু। অন্যদিকে, ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হারও যথেষ্ট উদ্বেগজনক আমাদের দেশে। ইউনিসেফের মতে, এই শিশু মৃত্যুর একটি অন্যতম বিষয় হল অপুষ্টি। আমরা অনেক সময় ছাড়িয়ে গেছি ইয়ামেন, জিবুতির মত আফ্রিকার দেশগুলোকে। নবজাতকের মৃত্যুর হারও আমাদের দেশে সর্বাধিক। ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত, ২০১৬-১৭ বর্ষের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের মাত্র ৬.৪% নুন্যতম পর্যাপ্ত আহার পায়।
তাহলে নরেন্দ্র মোদীর ‘আচ্ছে দিন’ কি পুরোপুরি মিথ ? অল্ট নিউজের প্রধান প্রতীক সিনহা মনে করেন, “আচ্ছে দিনে’র মতো শব্দবন্ধ বিজেপি ব্যবহার করেছিল একটা বিপণনের উদ্দেশ্য নিয়ে - যাতে শব্দটা মানুষের মনে গেঁথে যায়।” আদতে সেটাই ঘটেছে। কেন্দ্রের শাসক দল বর্তমানে এই শব্দবন্ধের ব্যবহার সচেতনভাবেই করছে না। তবে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ‘আচ্ছে দিনে’র আঁচ বেশ ঝাঁঝালো ভাবেই অনুভুত হচ্ছে সরকারের জনমোহনী প্রচারণায়। কেন্দ্রের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের রাজ্যসভায় প্রদত্ত একটি বিবৃতি থেকে জানা যায়, বিগত পাঁচ বছরে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন খাতে প্রায় ৩,৩৩৯ কোটি টাকা খরচ করেছেন! একটি লিখিত উত্তরে, শ্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন, সরকার ২০১৭-১৮ থেকে বর্তমান বছরের ১২ জুলাই পর্যন্ত প্রিন্ট মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করেছেন ১৭৫৬.৪৮ কোটি টাকা! অন্যদিকে, একই সময়ে ‘সাবকা সাথ, সাবকা বিকাশ’ বুলি আউড়ানো মোদী সরকারের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের ব্যয় ১৫৮৩.০১ কোটি টাকা। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন যে, ২০১৯ সাল থেকে ডিজিটাল মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন বাবদ সরকারের ব্যয় ২০.৫৮ কোটি টাকা। সম্মানিত পাঠক, সরকার প্রদত্ত উল্লেখিত পরিসংখ্যান ভীষন কিউট (!) তাই না ? একবার ভাবুন। আজকের শিশু আগামী দিনের রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি। এ পর্যন্ত উল্লেখিত পরিসংখ্যান আমাদের আক্ষেপকে দীর্ঘায়িত করবে নিঃসন্দেহে। অথচ রাষ্ট্রের ঝাঁ চকচকে বিজ্ঞাপনী মোড়কে চমক হরদিন। প্রচারের ঢাক্কা নিনাদে বিনি পয়সার ডাটা জিতে গেছে প্রয়োজনের আটাকে। সরকারের উন্নয়নের রঙিন (ফাঁপা) বিজ্ঞাপন চাপা দিতে চায়, আমার আপনার প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হওয়া সমস্যা গুলোকে। অদ্ভুত এক নেশায় বুঁদ হয়ে আছি আমরা। মানুষ চোখে পড়েনা। মানুষের সমস্যা চোখে পড়েনা। চোখে পড়ে তার দাড়ি, টুপি, টিকি, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস। অথচ, দেশ আজ দৈনন্দিন হাজারো সমস্যার জতুগৃহে পরিনত হয়েছে। দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত। বিলগ্নীকরণের ধুম উঠেছে সর্বত্র। নোটবন্দির দরুন নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি কুটিরশিল্প। বেকারত্বের সূচক ছাড়িয়ে বিগত ৪৫ বছরের লেখাজোকা। আজ ছাঁটাইয়ের জ্বরে কাবু হয়ে অনেকেই অফিস যায়। না, আমাদের হয়তো কোন খারাপ লাগা নেই, কারণ ভালো থাকার(!) ফাঁপা বিজ্ঞাপন তো আছেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct