রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের পর সীমান্ত নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ বেড়েছে। সম্প্রতি ড্রোন এবং ক্যামেরা সজ্জিত বেশ কয়েক জন রাশিয়ানকে গ্রেফতার করেছে নরওয়ের পুলিশ। তেল ও গ্যাস সংক্রান্ত বিষয়ে অস্বাভাবিক আগ্রহ দেখা যায় তাদের মধ্যে। এরকম বেশ কয়েক জন সন্দেহভাজন গুপ্তচর স্টরস্কোগ বর্ডার দিয়ে নরওয়েতে প্রবেশ করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করেছে রাশিয়া। এ নিয়ে লিখেছেন সাইমন টিসডাল। আজ শেষ কিস্তি।
এই অবস্থায় ইইউ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ, পুতিন ইউরোপের বিরুদ্ধে তার অঘোষিত শক্তি-যুদ্ধের অংশ হিসেবেই নর্ড স্ট্রিমে নাশকতা ঘটিয়েছিল। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেন পুতিন। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না, রাশিয়া যে নাশকতা ঘটায়নি, এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি পুতিন।অবস্থা পর্যবেক্ষণে বলা যায়, প্রেসিডেন্ট পুতিন যেন কোনোমতেই থামবেন না। তার নিকট কোনো যুক্তিই পাত্তা পাবে না। এরূপ অবস্থায় ইউরোপীয় নেতারা খুব ভালো করেই জানেন, ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন বন্ধ করার জন্য আগামী দিনগুলোতে কী কী করতে পারেন রাশিয়ান স্বৈরশাসক। পুতিন ইউরোপের সরকারগুলোকে দুর্বল করার যাবতীয় চেষ্টা চালাবেন— বাস্তবতা এটাই। পুতিন বাহিনী যেহেতু ইউক্রেন যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে এবং পুতিনের পারমাণবিক হুমকিও খুব একটা কাজে আসছে না, তাই ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার বৃহত্তর দ্বন্দ্বের আশঙ্কা বাড়ছেই।
যৌক্তিক এবং বিচক্ষণ চিন্তা হলো, মরিয়া পুতিন ইউরোপে হাইব্রিড আক্রমণ চালাতে পারেন। এই আশঙ্কাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এ কারণেই পশ্চিমা নিরাপত্তা ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ট্রান্সআটলান্টিক ইন্টারনেট কেবল নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ফ্রান্স। ২০২৩ সালের বাজেটে ‘সমুদ্রের তলদেশ’ প্রতিরক্ষার জন্য ৩.১ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ দিয়েছে দেশটি। ড্রোন এবং আন্ডারওয়াটার রোবটের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে অতিরিক্ত ১১ মিলিয়ন ইউরো। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, ‘যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামো তথা তার, স্যাটেলাইট এবং তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের নিরাপত্তা জোরদার করেছি আমরা। এ ব্যাপারে আরো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’ নড়েচড়ে বসছে ব্রিটেনও। প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্যের প্রথম মাল্টি-রোল সমুদ্র নজরদারি জাহাজ ২০২৩ সালে চালু হবে।’ প্রতিরক্ষা কর্মীদের প্রধান অ্যাডমিরাল স্যার টনি রাদাকিন এর আগে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, যোগাযোগের কোনো তার বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হলে তাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখা হবে। যদিও যুক্তরাজ্যকে ততটা প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে না। উদ্বেগের বিষয় হলো, উপসমুদ্র যোগাযোগের তারে ঘটা সাম্প্রতিক ‘বিঘ্ন’, যা শেটল্যান্ড দ্বীপবাসীকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তা নিয়ে পর্যাপ্ত তদন্ত করা হয়নি। ঘটনাটি হাইব্রিড যুদ্ধের সম্ভাব্য আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলছে। ইইউ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ইউটিলিটি এবং কম্পিউটার সিস্টেম থেকে শুরু করে বিমানবন্দর এবং হাসপাতাল পর্যন্ত সবকিছুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা শতভাগ সম্ভব নয়। এই দুর্বলতা নাটকীয়ভাবে সামনে আসে কিছুদিন আগে যখন জার্মানির রেলওয়ে নেটওয়ার্কের কিছু অংশ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য রাশিয়ার নাম আসে।
ন্যাটো ২০১৬ সালে ঘোষণা করেছিল যে, এক বা একাধিক মিত্রদের বিরুদ্ধে ‘হাইব্রিড অ্যাকশন’ পরিচালিত হলে তাকে উত্তর আটলান্টিক চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী সবার ওপর আক্রমণের শামিল হিসেবে গণ্য করা হবে। গত জুনে ন্যাটো ঘোষণা করে, ‘প্রতিপক্ষকে অস্থিতিশীল করতে দীর্ঘদিন ধরে হাইব্রিড প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চালানো আক্রমণগুলোয় নতুন যা যুক্ত হয়েছে তা হলো তাদের গতি, স্কেল এবং তীব্রতা, দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তন।’ ‘কাউন্টার-হাইব্রিড সাপোর্ট টিম’ এক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করবে যদিও, কিন্তু দেশগুলোর প্রাথমিক কাজ হলো—সর্বাগ্রে নিজেদের রক্ষা করা। ইউক্রেন সংঘাতের মধ্য দিয়ে ইউরোপে ‘হাইব্রিড হুমকি’ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা গ্যাসের মূল্য এবং অন্যান্য জ্বালানি সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নিতে একমত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে মতের অমিল রয়েছে যদিও, কিন্তু শীতকালের কথা মাথায় রেখে জ্বালানি সমস্যা-সংকটের ইতি টানতে সবাইকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে পথ খুঁজতে দেখা যাচ্ছে। আজকের ইউরোপে এটাই বাস্তব ঘটনা। বিভাজন, ব্যাঘাত, অস্থিতিশীলতা—এগুলো ইউরোপ এবং সরকারগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মিশনে নেমেছেন পুতিন। সত্যিকার অর্থে, এটিই তার লুকানো হাইব্রিড যুদ্ধের কৌশল। ইউক্রেনের মাটিতে তিনি হেরে যাচ্ছেন। একের পর এক ইউক্রেন থেকে দুঃসংবাদ শুনতে হচ্ছে তাকে। সবশেষে একটা কথা বলতেই হয়, ইউক্রেনে পুতিন হেরে যাচ্ছেন বটে; কিন্তু তিনি কি ইউরোপের ‘ইচ্ছা ভাঙার যুদ্ধ’ জিতছেন, কিংবা এ যুদ্ধে জয়ী হতে চলেছেন? শীত আসছে—এবং এই শীতই এই প্রশ্নের উত্তর বলে দেবে। (সমাপ্ত...)
দ্য গার্ডিয়ান থেকে
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct