শুধু ইউক্রেন নিয়ে এই যুদ্ধ নয়। গোটা বিশ্ব যে নিয়ম মেনে চলবে, তা কে নির্ধারণ করবে—তার একটি লড়াইও বটে। দ্বন্দ্বটি আসলে আট বছর আগে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল দিয়ে শুরু হয়। ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে ইউক্রেনকে মুছে ফেলার এবং বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করার জন্য রাশিয়ার চলমান অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এই যুদ্ধ সমগ্র পৃথিবী ভয় সৃষ্টি করে তুলছে। সেই আতঙ্ক আবহর কথা তুলে ধরে বিশ্লেষণ করেছেন ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অলেক্সি রেজনিকভ। আজ শেষ কিস্তি।
রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে বিশ্বের অনেক ধনী এবং সবচেয়ে উন্নত জাতিও পশ্চিমা সভ্যতার মূল নীতিগুলিকে রক্ষা করতে চরম অনীহা প্রকাশ করেছে। এটি সম্ভবত দীর্ঘ কয়েক দশকের শান্তি এবং ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির কারণে হয়েছে। এটি এমন এক বিশ্বের বিভ্রম তৈরি করেছে যেখানে প্রাচীনকালের মতো সামরিক আগ্রাসন ও ভয়াবহ বর্বরতার মাধ্যমে রাতারাতি যে কোনো দেশ দখল করে নেওয়া যায়। ইউরোপে প্রত্যাখ্যানের বিরাজমান মেজাজ রাশিয়ান সমাজকে পশ্চিমা সভ্যতার সুবিধা ভোগ করার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাবিরোধী ফ্যাসিবাদী আদর্শকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে। মস্কো সক্রিয়ভাবে পশ্চিমা মূল্যবোধকে আক্রমণ করে এবং নিয়মিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অদম্য প্রতিপক্ষ হিসেবে চিত্রিত করে। অথচ একই সময়ে, ক্রেমলিনের অভিজাত এবং রাশিয়ার মধ্যবিত্তরা তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পশ্চিমে বসবাস করতে এবং ইউরোপের উচ্চতর শিক্ষা ও স্বাস্হ্যসেবার সুযোগের সুবিধা নিতে পাঠায়। তারা পশ্চিমা রিয়েল এস্টেট ক্রয় করে, পশ্চিমা ব্যবসায় বিনিয়োগ করে, পশ্চিমা আদালতে তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করে এবং তাদের সঞ্চয় একই পশ্চিমা মুদ্রায় রাখে।
রাশিয়ানরা গণতন্ত্রের ফল ভোগ করলেও গণতন্ত্রের প্রতি তাদের ঘৃণা প্রকাশ করার মধ্যে কিছু ভুল দেখে না। একইভাবে, তারা ইউক্রেনীয়দের ‘ভাই’ বলতে সম্পূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। আবার একই নিশ্বাসে ঘোষণা করছে যে, ইউক্রেনের অস্তিত্ব থাকতে দেওয়া যাবে না। এই অযৌক্তিক পরিস্থিতির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত রুশ আগ্রাসনের অবসানের আশা কম। দেশটিকে কঠিন অংশীদার বা প্রতিযোগী হিসেবে দেখার পরিবর্তে, পশ্চিমা বিশ্বকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে আজকের রাশিয়া একটি দ্ব্যর্থহীন শত্রু শক্তি যা সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। তাই এখন রাশিয়াকে সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। দ্বৈত আচরণের দিন শেষ হয়ে গেছে। রাশিয়ান ট্যাঙ্কগুলিতে ‘টু বার্লিন’ বা ‘বার্লিনের দিকে’ স্লোগান লেখা এবং তা জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক হিসাবে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টিভিতে প্যারেড প্রদর্শনের আপনি বিলাসবহুল জার্মান গাড়ি চালানোর আশা করতে পারেন না। আপনি একইসঙ্গে ইউরোপকে পরমাণু হামলার হুমকি দেওয়ার সময় ফরাসি ওয়াইন বা ভিয়েনিজ কফি পান করার আশা করতে পারেন না। এই প্রেক্ষিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করা উচিত এবং বন্ধ করা উচিত এর ফাঁকফোকরগুলি। রাশিয়ান নাগরিকদের একটি শেনজেন জোন টু্যরিস্ট ভিসা নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হওয়া উচিত, তাদের শুধু মানবিক কারণে ইইউতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া যায়। কেননা এটা প্রমাণিত যে, রাশিয়ার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইউক্রেনের যুদ্ধকে সমর্থন করছে।ইউক্রেন এবার ত্রিশতম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করল। ইউক্রেনীয়রা এখন তাদের দেশের জন্যই লড়াই করছে। রাশিয়ান আক্রমণের প্রথম ছয় মাসে ইউক্রেন পর্যবেক্ষক বিশ্বকে প্রভাবিত করেছে এবং আমাদের অংশীদারদের কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পেয়েছে। এতে আর্টিলারি এবং এমএলআরএস সিস্টেম থেকে শুরু করে সাঁজোয়া যান এবং গোলাবারুদ পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন তৃতীয়-এর নেতৃত্বের জন্য ধন্যবাদ। ইউক্রেন ডিফেন্স কন্টাক্ট গ্রুপটি ৫০টিরও বেশি দেশকে রামস্টেইন ফর্ম্যাটে একত্রিত করেছে। ধন্যবাদ যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেসকেও। তার নেতৃত্বে ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য একাধিক দাতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডেনমার্ক এবং এর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মর্টেন বোডসকভের সক্রিয় অবস্হানের জন্য এই উদ্যোগটি সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে আমরা এখন উত্তর ইউরোপের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে বিশেষভাবে শক্তিশালী সমর্থন উপভোগ করছি। আক্রমণের প্রথম দিন থেকেই, ইউক্রেন পোলিশ সরকার ও জাতির কাছ থেকে অভূতপূর্ব সমর্থন পেয়েছে। লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়া থেকে আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধুরা আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলিতে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা কানাডা, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, েস্লোভাকিয়া, জার্মানি এবং অন্যান্য অনেক রাজ্যের পাশাপাশি আমাদের তুর্কি অংশীদারদের সমর্থনের জন্য প্রশংসা করি। আমি এ কথা জানাতে পেরে খুশি যে ইউক্রেনের অংশীদারদের তালিকা বিস্তৃত এবং ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেন রাশিয়ান সামরিক বাহিনীকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করতে সফল হয়েছে। ক্রেমলিনের অভিজাত সৈন্যদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশসহ প্রায় ৪৫ হাজার রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে। শতাধিক যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টারসহ হাজারের বেশি রাশিয়ান ট্যাঙ্ক জব্দ বা ধ্বংস করা হয়েছে। মূল সাফল্যের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ান ব্ল্যাক সি ফ্লিট ফ্ল্যাগশিপ ও দ্য মস্কভা ডুবিয়ে দেওয়া, কিয়েভের যুদ্ধে বিজয় এবং স্নেক আইল্যান্ডের মুক্তি ইত্যাদি।ক্রেমলিন পশ্চিমা দুর্বলতার ওপর নির্ভর করছে এবং বিশ্বাস করে যে, ইউরোপীয় নেতারা শেষ পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ব্যয় এবং ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কৌশলের সংমিশ্রণের মুখোমুখি হবেন। এই প্রত্যাশা সঠিক প্রমাণিত হলে, ইউরোপীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পরিণতি হবে বিপর্যয়কর। এর পরিবর্তে, পুতিনকে পরাজিত করার কাজটি শেষ করতে ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করাটাই হবে ইউরোপের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করা। (সমাপ্ত...)
(লেখক ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী)
আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct