শুধু ইউক্রেন নিয়ে এই যুদ্ধ নয়। গোটা বিশ্ব যে নিয়ম মেনে চলবে, তা কে নির্ধারণ করবে—তার একটি লড়াইও বটে। দ্বন্দ্বটি আসলে আট বছর আগে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল দিয়ে শুরু হয়। ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে ইউক্রেনকে মুছে ফেলার এবং বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করার জন্য রাশিয়ার চলমান অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এই যুদ্ধ সমগ্র পৃথিবী ভয় সৃষ্টি করে তুলছে। সেই আতঙ্ক আবহর কথা তুলে ধরে বিশ্লেষণ করেছেন ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অলেক্সি রেজনিকভ। আজ প্রথম কিস্তি।
গত ২৪ আগস্ট ইউক্রেনের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। ইউক্রেন তার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের পর তিন দশকের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো একটি সত্যিকারের বিপদসংকুল পরিস্হিতির মধ্যে পড়েছে। ফলে এ বছর দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে কোনো ছুটি দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। ঠিক ছয় মাস আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়া ইউক্রেনের রাষ্ট্রত্বকে চূর্ণ করার এবং ইউক্রেনীয় জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে দেশটিতে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু করে। এ বছরের প্রথম দিকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে যে গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরু করেন তা আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসে নজির বিহীন। এটি অনেক ইউরোপীয়দের জন্য একটি জেগে ওঠার আহ্বানস্বরূপ। কেননা যতই অস্বীকার করা হোক, আসলে এই মহাদেশ শত্রুরাষ্ট্র রাশিয়ার হুমকির মধ্যে পড়েছে।
এখনও অবধি, ক্রেমলিনের অপরাধমূলক পরিকল্পনা ইউক্রেনীয় শক্তি এবং সাহস দ্বারা ব্যর্থ হয়েছে। মাত্র তিন দিনের মধ্যে রাশিয়ার এই হামলা বিজয় অর্জনের মাধ্যমে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই যুদ্ধ এখন সপ্তম মাসে পদার্পণ করেছে। এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে তা কেউ জানেন না। পুতিন জয়লাভের মাধ্যমে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে তার সৈন্যদের নিয়ে প্যারেড করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার পরিবর্তে মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ইউক্রেন রাজধানীর কেন্দ্রস্হলে ধ্বংস হওয়া রাশিয়ান ট্যাঙ্কগুলির একটি ‘প্যারেড’ উন্মোচন করেছে। ইউক্রেনের সাফল্য উত্সাহজনক হলেও রাশিয়া যে ইউক্রেনকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা ত্যাগ করেনি—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর বিপরীতে, মস্কো যে কোনো প্রকারে তার গণহত্যামূলক এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আগের চেয়ে আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে। ‘ইউক্রেনের জনসংখ্যার প্রতি কোনো করুণা নয়’—একজন সিনিয়র রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক এমন বিবৃতিই বলে দেয় ইউক্রেনকে ধ্বংস করতে রাশিয়ার অভিপ্রায় কতটা বিপজ্জনক। অথচ ইউক্রেনীয়রা কেবল তাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য নয়, একটি জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে। রাশিয়ার এই আচরণের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিপদের মুখোমুখি হলেও তা ইউরোপের অনেক দেশের অস্বীকার করার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
শুধু ইউক্রেন নিয়ে এই যুদ্ধ নয়। গোটা বিশ্ব যে নিয়ম মেনে চলবে, তা কে নির্ধারণ করবে—তার একটি লড়াইও বটে। দ্বন্দ্বটি আসলে আট বছর আগে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল দিয়ে শুরু হয়। ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে ইউক্রেনকে মুছে ফেলার এবং বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্হার ভিত্তিকে দুর্বল করার জন্য রাশিয়ার চলমান অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৪ সালের বসন্তকালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের সময় ভ্লাদিমির পুতিনের নির্লজ্জ অস্বীকৃতির পর থেকে, ক্রেমলিন তার কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে মিথ্যার বেসাতিকে। মস্কো নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা যে শক্তিহীন, তা প্রমাণিত হয়েছে। জাতিসংঘ, ওএসসিই, আইসিআরসি ও অন্যান্য সবাই রাশিয়াকে যুদ্ধে বাধা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং ক্রেমলিনের ওপর অর্থবহ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে অক্ষম হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে, এটি শুধু রাশিয়ান আগ্রাসনকে আরও উত্সাহিত করেছে। আমরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে রাশিয়া প্রকাশ্যে একটি গণহত্যামূলক যুদ্ধ চালাচ্ছে এবং একইসঙ্গে পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলে জড়িত রয়েছে। ক্রেমলিনের কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে পারমাণবিক হামলার সম্ভাবনা নিয়ে ইউরোপকে হুমকি দিচ্ছে, যখন রাশিয়ান সামরিক বাহিনী জাপোরিঝিয়ায় জব্দ করা ইউক্রেনীয় পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জিম্মি করার কাজে ব্যবহার করছে। এটা সুস্পষ্ট যে ক্রমবর্ধমানভাবে বৈশ্বিক নিরাপত্তার অবনতি হচ্ছে। এটা এড়াতে নাটকীয় পরিবর্তন প্রয়োজন। যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সভ্য বিশ্বের স্তম্ভ হিসাবে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারা স্পষ্টতই তাদের পথ হারিয়েছে এবং আবার মূল বিষয়গুলিতে ফিরে যেতে হবে।এই অস্বস্তির সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো আগস্টের শুরুতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এটি ইউক্রেনের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের পরিস্হিতিকে সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ইউক্রেনীয়দের নিজেদের রক্ষা করার অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে।
(লেখক ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী)
আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct