ইট ছুড়লে পাটকেল খেতে হবে
ফৈয়াজ আহমেদ
ইট ছুড়লে পাটকেল খেতে হয়, এটি স্বতঃসিদ্ধ কথা। এতকাল ধরে প্রকৃতির সাথে মানবজাতি যে বিরূপ আচরণ করেছে, এখন প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। জলবায়ুর চরমভাবাপন্নতা তারই এক প্রতিউত্তর। সারা বিশ্বে খরা, অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, প্রচণ্ড উত্তাপ-উষ্ণতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অজ্ঞাত সব রোগবালাই বিশ্বসভ্যতার জন্য এখন এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এসব দুর্যোগ দুর্বিপাক ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তাতে মানুষ এখন ভীত, শঙ্কিত, বিস্মিত ও বিষন্ন আগামী দিনের পরিণতির কথা ভেবে। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এমন পরিস্থিতি মানুষের নিজেরই হাতের কামাই। এখন ইউরোপসহ বিশ্বজুড়েই চলছে প্রচণ্ড খরা ও অসহনীয় দাবদাহ। এটিকে বলতে হবে মানবজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত। জলবায়ু এমন ভয়ঙ্কর খেয়ালিপনার অন্যতম একটি প্রধান হেতু- বৈশ্বিক উষ্ণতা। এর পেছনে রয়েছে শিল্পোন্নত পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের শিল্প-কারখানা থেকে অনবরত ও মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ। যে কারণে তার বহু অশুভ প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার কারণেই অনাবৃষ্টি, দাবদাহ, খরা। এখন উষ্ণতাজনিত দুর্দান্ত খরা দাবদাহ ইউরোপসহ পুরো পৃথিবী যেন উত্তপ্ত চুল্লি হয়ে উঠছে। সে কারণে সেই মহাদেশের বহু নদ-নদী এখন শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। সেই সাথে জলের অভাবে ক্ষেত-খামারের মাটি ফেটে চৌচির হচ্ছে। এর পরিণতিতে আগামীতে শস্য উৎপাদনে ঘাটতি, সেই সাথে কৃষিজীবীদের জন্য দারিদ্র্য অপেক্ষা করছে। এই সমস্যা প্রকৃতপক্ষে আরো বহু সমস্যার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটাবে। জলবায়ুর এমন বৈরিতা সামনে রেখে কিছুকাল আগে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইংল্যান্ডে। সে সম্মেলন থেকে যে সুপারিশগুলো প্রস্তাবাকারে গৃহীত হয় তার অন্যতম ছিল কার্বন নিঃসরণ দ্রুত হ্রাস করা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্রুত কমিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ। কিন্তু উদাসী মানুষ হয়তো তার অস্তিত্ব অবসানের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। সে জন্যই মনে হয় সেই প্রস্তাবগুলো এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্তাকারে থেমে আছে। এমন অনিবার্য ধ্বংস নিয়ে কারোই যেন কোনো সংবিত নেই। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব কপ-২৬ সম্মেলনকালেই এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন যে, মানবসভ্যতা এখন ধ্বংসের মুখোমুখি, ভয়াবহ সেই দুর্যোগের ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠেছে। এর প্রতিবিধানের জন্য আর মুহূর্তকাল অপেক্ষা করা যাবে না। সেই মুহূর্তকাল এখন বছর ঘুরতে চলছে, কিন্তু কেউই সে আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না। এ দিকে, কপ-২৬ সম্মেলন থেকে যে কয়টি দেশের নামোল্লেখ করে বলা হয়েছিল এরাই জলবায়ুর বিরূপতার প্রথম ও প্রধান শিকার হবে। তার মধ্যে ভারতের নাম উপরের দিকে। তার প্রমান আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। সে সম্মেলন থেকে হুঁশিয়ার করা হয়েছিল, ভারতের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের এক বিরাট এলাকা সমুদ্রের নোনা জলের কয়েক ফুট নিচে তলিয়ে যাবে। জলবায়ুর এমন অস্বাভাবিকতার কারণে দেশব্যাপী প্রচণ্ড খরা, উষ্ণতা, অনাবৃষ্টি, যা কিনা এই ভরা বর্ষা মৌসুমের আবহাওয়ার সাথে একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব দৃষ্টান্ত এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের চিন্তিত, ভীত করে তুললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে তেমন কোনো বোধ-বিবেচনা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করা বা বোঝার নজির দেখা যায়নি। অর্বাচীন জনতার মতো যেন তাদের ভাবভঙ্গি। এমন বিপর্যয় প্রকৃতপক্ষে মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে তো বটেই, সেই সাথে সড়ক জনপথ মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে।
এ দিকে, জলবায়ুর যে বিপর্যয়কর অবস্থা তার ওপর একশ্রেণীর ক্ষমতাধর দুরাচারী নির্বিবাদে যত অপকর্ম করে যাচ্ছে, যার জের হিসেবে ঘটছে নানা বিপদ। এদের অপকর্মের জন্য হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে ক্ষেত-খামার বিলীন হচ্ছে, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে যা কিনা জলবায়ুজনিত সমস্যাকে প্রকটতর করে তুলবে। এসব অপকর্মের হোতাদের পেছনে রাজনৈতিক মদদ থাকায় তাদের ঔদ্ধত্য সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমন বিবেকহীনতার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভূবিজ্ঞানীরা তাদের অধ্যয়ন-গবেষণাসঞ্জাত জ্ঞান থেকে এই বার্তা দিচ্ছেন, পাহাড়ের তাৎপর্য অপরিসীম। পাহাড় পৃথিবীর ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করে। পাহাড়, টিলা ধ্বংস করা হলে এই ভূখণ্ডের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। পাহাড় টিলাকে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। যেভাবে পাহাড় ধসে এখন হতাহতের ঘটনা ঘটছে; কিন্তু পাহাড় ধ্বংস করা হলে তার পরিণতি তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ হবে। পাহাড় ধ্বংস হলে ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের প্রকোপ বাড়বে, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে। জীবন ও সম্পদ বিনষ্ট হবে অনেক। প্রকৃতি বা পাহাড়কে প্রাকৃতিকভাবেই থাকতে দিতে হবে।পাহাড় ভারসাম্যকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং একই সাথে বায়ুমণ্ডলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেই সাথে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্সের সুরক্ষা দেয়। এত সব কিছুর বিবেচনায় বিভিন্ন দেশে পাহাড়গুলোকে সযতনে দেখভাল করা হয়। যদি একান্তই কখনো প্রয়োজন হয় সেসব পাহাড়ে রাস্তাঘাট নির্মাণের, তবে পাহাড়ের তেমন ক্ষতি না করে সুড়ঙ্গ কেটে পথ তৈরি করে নেয়া হয়। আর আমাদের এখানে নির্বিচারে বছরে ৩৬৫ দিনই যার যখন যেভাবে মন চায় নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পাহাড় কাটছে- কেউ বসবাসের জন্য বা পথ রচনা করতে, কেউবা আবার বাণিজ্যি করতে পাহাড় কেটে আবাসিক প্লট সৃষ্টি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে বন কর্তৃপক্ষের হেলা অবহেলায় এমনই কথা বলতে হয়, তাদের সহযোগিতায়ই দেশের বনাঞ্চল উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। অথচ জলবায়ু বৈরিতার মুখে এবং তার ভয়াবহ ছোবল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বিভিন্ন কর্মসূচিসহ বৃক্ষরোপণকে গুরুত্ব দিচ্ছে গোটা বিশ্বই। উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা, তার অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সে দেশে জলবায়ু মোকাবেলার জন্য বৃক্ষরোপণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ট্রুডো ঘোষণা করেছেন, কানাডাকে সবুজ বনানীতে ঢেকে দিতে কোটি কোটি বৃক্ষ রোপণ করা হবে। বহু দেশ জলবায়ু বৈরিতাকে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন কর্মসূচিসহ বৃক্ষরোপণকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে ফি বছরের মধ্যভাগে বর্ষা বাদলের মৌসুমে বিপুল অর্থ ব্যয় করে বৃক্ষরোপণের একটি সপ্তাহ পালন করে সরকার এবং লাখ লাখ গাছ রোপণ করার ‘রেওয়াজ’ রয়েছে। বিপুল অর্থ ব্যয় করে প্রতি বছর যে লাখ লাখ বৃক্ষরোপণ করা হয়, তার একটি হিসাব হয়তো কর্তৃপক্ষের কাছে পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু রোপিত এসব গাছের কতগুলো বেঁচে থাকছে, সে কথা জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ অবশ্যই ‘লা’ জবাব হয়েই থাকবে। তবে কেন এত অর্থ ব্যয় আর পণ্ডশ্রম। এ জন্য পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন তাৎপর্যহীন ও কোনো অবদানই রাখতে পারছে না। পরিবেশের সুরক্ষা, দেশের কাঠের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রতিটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকাটা আদর্শিক অবস্থান। মানুষের বসবাসের জন্য লোকালয়, আর পশুপাখির জন্য দরকার নিরাপদ অরণ্য। চোরাকারবারীরা সেই অরণ্যে হস্তক্ষেপ করে পশুপাখির স্থানকে বসবাসের অনিরাপদ থেকে তুলছে। সে কারণে বনের জন্তু জানোয়ারকে এখন প্রায়ই লোকালয়ে চলে আসতে দেখা যাচ্ছে। এসব জন্তু জানোয়ারের দেহে যে মারাত্মক রোগ-ব্যাধির জীবাণু রয়েছে তা মানব সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বব্যাপী যে মানবদেহে যত অজ্ঞাত রোগের সংক্রামণ লক্ষ করা যাচ্ছে, সেটি পশুর লোকালয়ে প্রবেশের কারণে। আধুনিকপরিবেশ বিজ্ঞানীদের সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, সৃষ্টিকর্তা পাহাড় পর্বত নদী-সাগর ভূপ্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন এমন একটি ভারসাম্য সহকারে যে, এর কোনো ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রম ঘটালে তা শুধু প্রকৃতিকে নয়, গোটা পরিবেশেই সৃষ্টি হয় বিরূপ প্রতিক্রিয়া। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম আর শীতকালে তীব্র শীত। হিমালয় এলাকার বনরাজি নিশ্চিহ্ন হওয়ার ফলে আমাদের দেশে মাঝে মধ্যে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct