কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বিশেষ করে টুইটারে একটি কার্টুন অনেকেরই নজর কেড়েছে। কার্টুনটিতে দেখা যাচ্ছে, একজন ফিলিস্তিনি নারীকে দুইভাবে আঁকা হয়েছে। এক পাশে দেখা যাচ্ছে, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। আরেক পাশে সেই মা বহন করছেন শিশুসন্তানের মরদেহ। শিশুটি রক্তাক্ত, তার দেহে জড়ানো ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যবাহী রুমাল ও লাল-সবুজ পতাকা। মায়ের চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ফিলিস্তিনিরা কী দুর্দশার মধ্যে আছেন তা তুলে ধরেছেন রাফসান গালিব। আজ শেষ কিস্তি।
এবারের ইসরাইলি হামলায়ও পশ্চিমা মোড়লদের একই সুর আমরা পাই। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের ভাষ্য ছিল এমন, ইসরাইলের নিজেকে রক্ষার অধিকার রয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে একই বাক্যই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে থাকেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসও ইসরাইলের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মূলত ফিলিস্তিনে ইসরাইলের হামলার ন্যায্যতাই দেওয়া হয়। আরও লক্ষণীয় বিষয় ছিল, এবারের ঘটনায় আরব দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদও খুব একটি চোখে পড়েনি। আরব লীগ প্রতিক্রিয়া জানালেও সেটি তেমন জোরালো ছিল না। ফিলিস্তিনিদের প্রতি বরাবরই এমন আচরণ কি করে না আরব বিশ্ব? আরব দেশগুলো ইসরাইলকে সরাসরি স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে—বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিকভাবে সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচেষ্টায় সেটি শুরু হয়। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফরকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের আকাশও উন্মুক্ত হয়ে গেল ইসরাইলের জন্য। ফলে এমন পরিস্থিতিতে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের পাশে আরব বিশ্বকে আশা করাই এখন ভুল।ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমা মিডিয়ার একচোখা নীতি নতুন নয়। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি প্রাথমিক স্কুলে ১৯ জন শিশু নিহত হয়েছিল বন্দুকধারীর হামলায়। এমন ঘটনায় গোটা বিশ্বের মিডিয়াই মানবিক হয়ে ওঠে। এমন ঘটনায় আমরাও স্তব্ধ হয়ে যাই। সেটিই স্বাভাবিক। তবে ফিলিস্তিনি শিশুদের ক্ষেত্রে তেমন মানবিকতা আমরা পাই না পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর কাছে। ইউক্রেনেও রাশিয়ার হামলায় নিহত হচ্ছে শিশুরা। গত মাসের মাঝামাঝিতে রুশ হামলায় নিহত হয় লিজা নামে তিন বছর বয়সী এক ইউক্রেনীয় শিশু। পরির মতো ফুটফুটে শিশুটির মৃত্যুই প্রমাণ করে যুদ্ধের ভয়াবহতা। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া যেভাবে ইউক্রেনের একটি শিশুর নামকে এককভাবে তুলে আনল, তেমনটি আমরা দেখি না ফিলিস্তিনি শিশুদের ক্ষেত্রে। ইসরাইলি হামলায় ফিলিস্তিনের এত এত শিশু নিহত হয়, তাদের কারও নামটি জানা হয় না আমাদের।
বিষয়টি খুবই করুণভাবে ওঠে আসে ফিলিস্তিনি পলিসি নেটওয়ার্ক আল-শাবাকার সদস্য ইয়ারা হাওয়ারি কণ্ঠে। ৯ আগস্ট কাতারভিত্তিক আলজাজিরায় এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আমরা জানি, আমরা ইউক্রেন না। আমরা জানি, আমরা ইউক্রেনীয়দের মতো একই ধরনের সমর্থন পাব না। দখলধারী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে আমাদের যে অধিকার, সেটিকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসবে না। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদের শহীদদের মহিমান্বিত করে কোনো ছবি প্রকাশ করবে না। পপ তারকা, হলিউড অভিনেতা এবং প্রধানমন্ত্রীরা গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমাদের পরিবারগুলোকে দেখতে আসবে না।’ এমন সহজ-সরল বয়ানের মাধ্যমে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ইসরাইলি দখলদারির নির্মম শিকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে সামনের দিনগুলোতেও হয়তো আমরা ইসরাইলি হামলায় ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তাক্ত হতে দেখব। একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে তার শিশুদেরই আগে শিকার করতে হয়, সেটি কে না জানে। তবে তা হতে না দিতে ফিলিস্তিনি নারী বা মায়েরা কতটা বদ্ধ পরিকর সেটিও আমাদের জানা আছে। সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়া এসব মায়েরা একেকটি সাহসী ও নির্ভীক প্রজন্মই জন্ম দিয়ে যান, ইসরাইলি দখলদারির বিরুদ্ধে লড়তে। মাহমুদ দারবিশও তাঁর কবিতায় বলে গেছেন—‘আমাদের এই ভূমি বন্ধ্যা নয়/ প্রতিটি ভূমির রয়েছে একটি জন্মক্ষণ/ প্রতিটি সকালেই রয়েছে বিপ্লবের জন্য প্রতিশ্রুতি।’ (সমাপ্ত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct