করোনার পাশাপাশি মাঙ্কিপক্সও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্বেগ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে মাঙ্কিপক্স নিয়ে আন্তর্জাতিক জরুরি সতর্কতা ঘোষণা করেছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রেসুস। মাঙ্কিপক্স আমাদের দেশে একজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। মাঙ্কিপক্স সতর্কতায় প্রকাশ করা হল এই বিশেষ প্রতিবেদন।
কোভিড-১৯ মোকাবিলা করতেই ক্লান্ত-সর্বস্বান্ত সারাবিশ্ব। তার ওপর বিশ্ববাসীকে নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে বিরল রোগ মাঙ্কিপক্স। ২০২২ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৭৪টি দেশের ১৬ হাজার ৮৩৬ রোগী শনাক্ত হয়েছে। রোগটিতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। সে পরিপ্রেক্ষিতেই করোনার পাশাপাশি মাঙ্কিপক্সও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্বেগ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে শনিবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে মাঙ্কিপক্স নিয়ে আন্তর্জাতিক জরুরি সতর্কতা ঘোষণা করেছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রেসুস।
প্রথম শনাক্ত : ১৯৭০ সালে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে মানুষের মধ্যে মাঙ্কিপক্স প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল। মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভাইরাসটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ঐতিহাসিকভাবে সাধারণ জনসংখ্যার মধ্যে ০ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ রোগে মৃত্যুর হার ৩ থেকে ৬ শতাংশ।
যেসব দেশে ছড়িয়েছে : সর্বশেষ দিল্লিতেও মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত একজনের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ভারতে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল চার-এ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে স্পেনে (৩ হাজার ১২৫ জন)। দুই হাজার রোগী ছাড়িয়েছে আমেরিকা, জার্মানি ও ব্রিটেনে। দুই হাজার ছুঁই ছুঁই করছে ফ্রান্স। পাঁচ শতাধিক করে রোগী রয়েছে নেদারল্যান্ডস, কানাডা, ব্রাজিল ও পর্তুগালে। ১০০ থেকে ৪০০ রোগী রয়েছে ইতালি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, পেরু, ইসরাইল ও নাইজেরিয়ায়। আক্রান্ত অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রিয়া, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো, ডেনমার্ক, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, চিলি, গ্রিস, ঘানা, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, মাল্টা, চেক প্রজাতন্ত্র, লুক্সেমবার্গ, ফিনল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কলম্বিয়া, আইসল্যান্ড, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, ক্রোয়েশিয়া, ক্যামেরুন, সিঙ্গাপুর, জিব্রাল্টার, সার্বিয়া, এস্তোনিয়া, লেবানন, বেনিন, বুলগেরিয়া, ডোমিনিকান রিপাবলিক, লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইকুয়েডর, নিউজিল্যান্ড, সৌদি আরব, তাইওয়ান, বাহামা, বার্বাডোস, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, কোস্টারিকা, জর্জিয়া, জ্যামাইকা, মার্টিনিক, মরক্কো, নিউ ক্যালেডোনিয়া, পানামা, কাতার, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভেনিজুয়েলা।
উপসর্গ ও লক্ষণ : মাঙ্কিপক্সের বেশ কিছু উপসর্গ রয়েছে। এ রোগের উপসর্গ হিসাবে জ্বরজনিত অসুখের সঙ্গে ঠান্ডা লাগা, ঘাম, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, পিঠে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, ফ্যারিঞ্জাইটিস, শ্বাসকষ্ট এবং কাশি হয়ে থাকে। জ্বরের পর ২-৩ দিনের মধ্যে ঘাড়ের চার দিকে মাঙ্কিপক্স দেখা যায়। ১ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ফুসকুড়ি তৈরি হয়। ফুসকুড়ি প্রায়ই মুখে শুরু হয়, তারপর ছড়িয়ে পড়ে শরীরের বাকি অংশে। এটি দুই থেকে চার সপ্তাহ ধরে চলতে পারে। মুখমণ্ডল, শরীর, হাত-পা এমনকি মাথার ত্বকেও ফুসকুড়ি হতে পারে। হাতের তালু এবং পায়ের পাতায়ও ক্ষত দেখা দিতে পারে। এগুলো ব্যথাহীন। যদি ব্যথা থাকে তাহলে এটি সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে হতে পারে। চুলকানিও থাকতে পারে।
মাঙ্কিপক্স কিভাবে ছড়ায় : সংক্রামিত ব্যক্তি বা প্রাণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে বা ভাইরাস দ্বারা দূষিত উপাদানের মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এটি যৌনসম্পর্কসহ ঘনিষ্ঠ শারীরিক যোগাযোগের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফুসকুড়ি ও এর ভেতরের তরল বিশেষভাবে সংক্রামক। পোশাক, বিছানা, তোয়ালে বা খাবারের মতো জিনিস-যা সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শ পেয়েছে, তাও অন্যদের সংক্রামিত করতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯৫ শতাংশ সংক্রমণ ঘটেছে যৌন সংক্রমণের মাধ্যমে। বৃহস্পতিবার ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’ সাময়িকীতে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। তারা এ বছরের ২৭ এপ্রিল থেকে ২৪ জুনের মধ্যে বিশ্বের ১৬টি দেশে শনাক্ত হওয়া ৫২৮ জন রোগীর ওপর গবেষণা করেন। গবেষণাপত্রের মুখ্য লেখক জন থর্নহিল এক বিবৃতিতে বলেন, সাধারণ অর্থে মাঙ্কিপক্স যৌনবাহিত সংক্রমণ নয়। কিন্তু তা ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংসর্গের মাধ্যমে হতে পারে। জন থর্নহিল বলেন, তাদের গবেষণা এই ইঙ্গিত দেয়, এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের অধিকাংশ ঘটনা যৌন ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রধানত পুরুষের সঙ্গে পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে এমনটা হয়েছে।
মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসা : অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাঙ্কিপক্সে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে অন্যদের সংস্পর্শ এড়াতে সংক্রামিত ব্যক্তিদের ফুসকুড়ি বা ঘা এলাকা ড্রেসিং দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। রোগীর মাউথওয়াশ এবং চোখের ড্রপ ব্যবহার করা যেতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিনিয়া ইমিউন গ্লোবুলিন (ভিআইজি) সুপারিশ করা যেতে পারে। এ ছাড়া মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে একটি অ্যান্টিভাইরাল-যা টেকোভিরিম্যাট বা টিপক্স নামে পরিচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বোচ্চ সতর্কতা : বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বিগ্ন হতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বব্যাপী এই রোগের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সংস্থাটি এ সতর্কতা জারি করে। শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে তেদ্রোস আধানম বলেন, ‘মাঙ্কিপক্স বিশেষ করে ইউরোপের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে এবং বিশ্বব্যাপী এটি আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে’। তিনি বলেন, ‘সঠিক কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে এর প্রকোপ ঠেকানো সম্ভব।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct