দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ ও সাংবাদিকদের উপর হামলার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজাপক্ষে সরকারের জোরালো জনসমর্থন ছিল, যার ফলে গোটাবায়া রাজাপাক্ষের দল শ্রীলঙ্কা পিপলস ফ্রন্ট পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে জয়লাভ করেছিল। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে রাজাপক্ষেরা দেশকে দেউলিয়াত্ব, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং ব্যাপক মূল্যস্ফীতির দিকে নিয়ে যান। জনগণের প্রতিশ্রুতি পূরণে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন সেই প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন প্রিয়াঙ্কা কৃষ্ণমূর্তি। আজ শেষ কিস্তি।
আরাগালিয়া এই দিক থেকে অস্বাভাবিক ছিল যে এটি সব ধরনের জাতিভিত্তিক শ্রীলঙ্কানদের স্বাগত জানিয়েছে। এপ্রিল মাসে, প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ের বাইরে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের কর্মীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা তামিলবিরোধী যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মারা যাওয়া তামিল বেসামরিক নাগরিকদের স্মরণে পানি এবং চালের গুঁড়ার মিশ্রণ (কাঞ্জি) রান্না করে খেয়েছিলেন। গৃহযুদ্ধের ওই সময়ে নির্বিচার গোলাবর্ষণের কারণে মৃত্যুর আগে সেই তামিলদের পক্ষে কাঞ্জি ছাড়া অন্য খাবার জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। এভাবে আরাগালিয়া এমন একটি অবস্থানে চলে আসে, যেটিকে লোকেরা রাজাপক্ষের রাজনীতির বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করে। বিক্ষোভকারীরা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য উদ্যাপন করতে শুরু করে। এটি এই চেতনা প্রদর্শন করে যে সুদিনের আশা নেতাদের কাছ থেকে নয়, বরং জনগণের শক্তি থেকে আসে। কিন্তু এই সংহতি কি শুধু নিজেদের সুবিধার জন্য এক ছাতার নিচে আসার বিষয়টিকে প্রতিফলিত করে? মাত্র আড়াই বছর আগে বর্তমান সরকারবিরোধী অনেক বিক্ষোভকারী রাজাপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির ধরনকে সমর্থন করেছিলেন। আজ তাঁদের অভিযোগ, পার্লামেন্ট প্রতারক ও মিথ্যাবাদীতে ভরে গেছে। তারপরও তারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তোষামোদকারীদেরই ভোট দিয়েছে।
দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদ এবং সহিংসতার সুবিদিত রেকর্ড থাকার পরও রাজাপক্ষেদের সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। যখন রাজাপক্ষে পরিবার জনসাধারণের তহবিল চুরি করছিল বা সংখ্যালঘুদের অধিকারকে পদদলিত করছিল, তখন কিন্তু কোনো প্রতিবাদ হয়নি। প্রতিবাদ হয়েছে তখন, যখন শুধু খাবারের দাবিতে আন্দোলন করায় সিংহলিদের ‘চরমপন্থী এবং সন্ত্রাসী’ বলা হয়েছিল। যে প্রতিষ্ঠানগুলো গোতাবায়ার ক্ষমতাকে সংহত করেছিল, সেগুলো এখন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। যে ব্যবসায়িক শ্রেণি ও অন্যান্য ক্ষেত্রের ক্ষমতাবানেরা রাজাপক্ষেদের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল, তাঁদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছি ছি করা হচ্ছে এবং যে অভিজাত বৌদ্ধ ধর্মযাজকই প্রতিবাদ বিক্ষোভে হাজির হওয়ার সাহস করছেন, তাঁদের নিন্দা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী এবং পুলিশ একসময় তঁাদের পরিষেবার জন্য প্রশংসিত হলেও এখন তাঁদের রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বাহিনী হিসেবে দেখা হচ্ছে। সংখ্যালঘুবিরোধী মনোভাব উসকে দেওয়ার জন্য প্রধান মিডিয়া সংস্থাগুলোকে নিন্দা করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো উদ্ভূত শূন্যতা পূরণ হবে কী দিয়ে। মর্যাদার এই সংগ্রামের ভিত্তিতে একটি নতুন পরিচয় গড়ে তোলার বিরল সুযোগ রয়েছে শ্রীলঙ্কানদের। পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও লাঠিপেটার শিকার হওয়ার পর সিংহলি বিক্ষোভকারীরা তামিলদের প্রতি চালানো সহিংসতা ও দুর্ব্যবহারের বিষয় কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছে। বিদ্যুতের অভাবে নিজেদের ব্যবসা ভেঙে পড়তে দেখার পর তারা এখন বুঝতে পেরেছে, বিক্ষুব্ধ জনতা মুসলমানদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার পরপর ভুক্তভোগীদের মধ্যে কী নিদারুণ দহন হয়েছিল। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব তীব্রভাবে অনুভব করার পর এখন সচ্ছল সিংহলিরা স্বীকার করছেন, বৃক্ষরোপণের কাজে নিয়োজিত জনজাতির কর্মীরা দৈনিক তিন ডলার আয়ে সংসার চালাতে পারে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সিংহলি-বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বাস করা সংখ্যালঘুদের কয়েক দশক ধরে বঞ্চনার শিকার করা হয়েছে। সিংহল বৌদ্ধরা তাদের অভ্যন্তরীণ তামিল এবং মুসলমানদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে। কিন্তু শুধু এই পরস্পরের ভাগ করে নেওয়া আঘাতের ওপর ভিত্তি করে শ্রীলঙ্কানরা রাজাপক্ষেদের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে একটি নতুন সামাজিক বোঝাপড়ায় রূপান্তরিত করতে পারে। আমাদের সাম্প্রদায়িক বন্ধন এবং সম্পর্কের পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে আমরা একটি নতুন সম্মিলিত পরিচয় তৈরি করতে পারি। এর অর্থ হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এবং দুর্নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে একটি মুক্ত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য আমাদের যৌথ সংগ্রামকে আলিঙ্গন করার সময় এসেছে। এই সময়টিকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।
লেখক শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন বিশ্লেষক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct