ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এক অনন্য প্রাকৃতিক নিদর্শন
ডোভারের শ্বেতচূড়া
ফৈয়াজ আহমেদ: ইংল্যান্ডের কেন্ট কাউন্টিতে অবস্থিত ডোভার শহরের সৈকতে ১০ মাইল বিস্তৃত রয়েছে এই শ্বেতচূড়াগুলো। এই চূড়াগুলো ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের সর্বনিম্ন দূরত্ব বিন্দু (প্রায় ২০ মাইল)। প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু এই চূড়াগুলো দূর থেকে নজরে আসলেই আপনি বুঝে যাবেন ইংল্যান্ডে পৌঁছে গেছেন। এই শ্বেতচূড়ার দিকে তাকালে মনে হবে সরাসরি সাগর থেকে উঠে এসেছে এই সাদা পাহাড়গুলো। অনেকটা শিশুদের কাঁপা হাতের চিত্রাংকনের মতো দেখতে প্রকৃতির হাতে গড়া এই চূড়াগুলোর শ্বেতশুভ্রতা সারাবিশ্বের পর্যটকদের নজর কেড়েছে। ইংল্যান্ডের শ্বেতচূড়াগুলো প্রথমে আপনাকে মুগ্ধ করবে। পরক্ষণেই এর গঠনশৈলী দেখে কৌতূহল জাগবে, কীভাবে গঠিত হয়েছিল এই শ্বেতচূড়া? পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটা বরফ যুগের সময় এই শ্বেতচূড়াগুলো গঠিত হয়েছে। সময়ের হিসাবে আজ থেকে প্রায় ৩৬ লাখ বছর পূর্বের ঘটনা। এর প্রধান উপাদান হচ্ছে চুনাপাথর। তবে ৭০ মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান ইংল্যান্ডের ভূমি সমুদ্রের নিচে নিমজ্জিত ছিল। সেই সাগর জলের নিচের পৃষ্ঠ শ্বেত কাদায় গঠিত ছিল। আর এই কাদার স্তর মূলত ককোলিথ নামক শৈবালের কাঠামোবিশেষ দ্বারা গঠিত হয়েছিল। ককোলিথ শৈবাল তখন সাগরের জলে ভেসে থাকতো। ককোলিথের কঙ্কাল কাঠামো দিয়ে গঠিত সেই শ্বেত কাদা একসময় নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে চুনাপাথরে রূপান্তরিত হয়। তবে এক-দুই বছরে চট করে এই পরিবর্তন সাধিত হয়নি। এ জন্য লেগে গেছে কয়েক মিলিয়ন বছর। এই চুনাপাথর জমা হওয়ার হার ছিল খুবই মন্থর। প্রতিবছর মাত্র আধ মিলিমিটার পরিমাণ চুনাপাথর জমা হতো। এই আধ মিলিমিটার চুনাপাথরে থাকতো ১৮০টি শৈবালের কাঠামো। এই মন্থর গতিতে চুনাপাথর জমতে জমতে একসময় এখানে গড়ে উঠে ৫০০ মিটার বিস্তৃত চুনাপাখরের স্তর। ককোলিথ ছাড়াও এই চুনাপাথরের মাঝে স্পঞ্জ, শামুকসহ বহু বিলুপ্ত সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম লুকিয়ে আছে। তাছাড়া বরফ যুগের শেষদিকে ইংলিশ চ্যানেলের দিক থেকে চুনাপাথরের আগ্রাসন ঘটে, যার ফলে বর্তমান ইংল্যান্ড সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তবে শ্বেতচূড়ার মতো বিস্তৃত কোনোকিছু গঠনে বিপুল পরিমাণ শৈবালের প্রয়োজন। সাধারণত দেখা যায়, অন্যান্য অণুজীবের সাথে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এসব শৈবালের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, শ্বেতচূড়া গঠনের জন্য শৈবালের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণ কী? এর কারণ হিসেবে সমুদ্রবিজ্ঞানীরা বেশকিছু ব্যাখ্যা বের করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, ককোলিথ এবং ডায়াটম নামক সামুদ্রিক শৈবালের বৃদ্ধি এবং বংশবিস্তারের পেছনে নাইট্রেট, লৌহ এবং সিলিকেট প্রধান ভূমিকা পালন করে। সাগরের কোনো অংশে লৌহের পরিমাণ বেশি থাকলে সেখানে এই দুই শৈবালের বংশবিস্তারের মাত্রা বেড়ে যায়। লৌহ এবং সিলিকেটের পরিমাণ বেশি থাকলে ডায়াটমের বৃদ্ধি ককোলিথকে ছাড়িয়ে যায়। উপরন্তু, উচ্চমাত্রার নাইট্রেট এবং অল্প পরিমাণ লৌহ থাকলে ককোলিথের বৃদ্ধি বেশি হয়। এ ধরনের পরিবেশই এখানে ককোলিথের উচ্চ হারের বংশবিস্তারের পেছনে দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে এ ধরনের উচ্চ বংশবিস্তারের কারণে এখানে গড়ে উঠেছে এই চূড়াগুলো। ইংল্যান্ডের ইতিহাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে এই শ্বেতচূড়ার নাম। এর প্রধান কারণ, শত্রুপক্ষ ইংল্যান্ডে প্রবেশের জন্য এই পথটি বেছে নিত। ডোভারের উচ্চভূমি তখন ইংরেজদের সামরিক এবং কৌশলগত সুবিধা প্রদান করত। ইতিহাসের অন্যতম সেরা রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারও ডোভার প্রণালী দিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণ করেছিলেন। ইতিহাসের পাতায় এই চূড়ার অভিষেক ঘটে তখনই- খ্রিস্টপূর্ব ৫৫ অব্দে। সেবার দুই লিজিয়ন রোমান সৈনিক নিয়ে সমুদ্রপথে আক্রমণ করেছিলেন জুলিয়াস সিজার। ডোভার সৈকতের নিকটে আসার পর সিজার বাহিনীর নজর গেলো এই শ্বেতচূড়াগুলোর দিকে। চূড়ার শীর্ষে ঝাঁকে ঝাঁকে সশস্ত্র সৈনিকরা সিজার বাহিনীকে পিছু হটানোর জন্য অপেক্ষা করছে। রণপটু সিজার বুঝতে পেরেছিলেন শত্রুপক্ষ ভৌগোলিক অবস্থানের পূর্ণাঙ্গ সুবিধা আদায় করে তার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তাই তিনি সেখানে নোঙর ফেলতে ব্যর্থ হন। বরং সিদ্ধান্ত পাল্টে ডিল এর উপকূলে নোঙর ফেলেন। সেই থেকে এই চূড়াগুলো দেশটির ইতিহাসে প্রাকৃতিক দুর্গ এবং প্রহরী হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তাছাড়া নির্বাসন শেষে রাজা ২য় চার্লস ১৬৬০ সালের মে মাসে ডোভারের সৈকতে পদার্পণ করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এই চূড়া।
শত্রুপক্ষের আগ্রাসন রুখে দিতে লৌহ যুগে পূর্বদিনের চূড়ায় স্থাপন করা হয়েছে দুর্গ। একাদশ শতকে স্থাপিত এই দুর্গগুলোতে পরবর্তীতে যুগোপযোগী সংস্কার করা হয়। দুর্গের পাশাপাশি চূড়ার বিভিন্ন অংশে খনন করা হয় একাধিক সুড়ঙ্গপথ। ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় এসব সুড়ঙ্গকে হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধেও এসব সুড়ঙ্গের ব্যবহার হয়েছিল। ডানকার্ক থেকে ব্রিটিশ সেনাদের উদ্ধার করার পর এখানে জড়ো করা হয়। সুড়ঙ্গপথে বেশ কিছু কুঠুরি নির্মিত হয়েছিল। এদের একটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্যার উইন্সটন চার্চিলের যুদ্ধকালীন ব্যক্তিগত কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। চার্চিলের নির্দেশে চূড়াগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে গোলন্দাজ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। এছাড়া অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট অস্ত্রও রাখা হয়েছিল এখানে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ডোভারের শ্বেতচূড়ার অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। তিলে তিলে ক্ষয়ে যাচ্ছে বরফ যুগে শৈবালের কঙ্কাল থেকে গঠিত হওয়া এই অসাধারণ নিদর্শন। ২০০১ সাল এবং ২০১৩ সালে এই চূড়ার বেশ বড় অংশ ক্ষয় হয়ে ধ্বসে যায়। সময়ের সাথে সাথে এই ক্ষয় হওয়ার হারও বেড়ে যাচ্ছে। এর পেছনে বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামুদ্রিক ঝড়ের মাত্রা পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন। জলবায়ু বদলের ফলে সমুদ্রসীমার উচ্চতায় বাড়ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে শক্তিশালী ঢেউয়ের আঘাতে ডোভারের চূড়ার ব্যাপক ক্ষয়সাধন হবে। প্রাকৃতিক কারণের বাইরে মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার কারণে এমনটি হচ্ছে বলে পরিবেশবাদীদের মত। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটকদের মুগ্ধ করা এই ডোভারের শ্বেতচূড়া একসময় হারিয়ে যাবে প্রকৃতির বুকে, তা মানা সহজ নয়। ইংল্যান্ড ছাপিয়ে এটি একটি আন্তর্জাতিক নিদর্শন। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং প্রকৃতির খাতিরে এর রক্ষণাবেক্ষণে কার্যকরী এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত কাম্য।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct