নিত্য ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিকল্প
ফৈয়াজ আহমেদ
আমাদের দৈনন্দিন কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। প্লাস্টিক ছাড়া যেন আমাদের জীবন কল্পনাই করা যায় না। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমরা প্লাস্টিক ব্যবহার করে থাকি। আর প্রতিদিনই এই ব্যবহার বেড়ে চলেছে। প্লাস্টিক নিঃসন্দেহে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তা জেনেও আমরা এর ব্যবহার বন্ধ করছি না। প্লাস্টিকের সহজলভ্যতা আর অতি কম মূল্য এমন একটা অভ্যাসে আমাদের পৌঁছে দিয়েছে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ২ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, যা বার্ষিক হিসেবে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন থেকে ১ ট্রিলিয়নের মধ্যে। যার মধ্যে ২৩ বিলিয়নই শুধুমাত্র নিউ ইয়র্ক শহরে হয়। এই প্লাস্টিক বিশ্বের সমুদ্রতীরে বসবাসকারী ১.১ মিলিয়ন পাখি এবং প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর প্রায় ৯০% পাখি এবং মাছের দেহে প্লাস্টিকের মাইক্রো-কণা আছে। একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ গড় ব্যবহার সময় মাত্র ১২ মিনিট! এতে পৃথিবীর সম্পদের বিপুল অপচয় এবং প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে গ্রহের মারাত্মক পরিণতিসহ আরো নানাবিধ প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে হলে আমাদের জরুরীভাবে প্লাস্টিকের ব্যাগের বিকল্প ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে হবে।
বিশ্বের অনেক দেশের সরকার প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। কোনো কোনো দেশ আবার নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এটি অস্বীকার করা সহজ নয় যে, বহু বছর ধরে এই ব্যাগ ব্যবহার করতে করতে আমরা সেগুলিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে এই ব্যাগ ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কথা কল্পনাই করতে পারি না। বাজারে বা দোকানে বিনামূল্যে প্লাস্টিকের ব্যাগগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বিতরণ হয়ে আসছে। আমরা ভোক্তারাও এর ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। আমাদের মতো এত বেশি পরিমাণে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা পরিবেশ দূষণের অন্যতম একটি কারণ। পৃথিবী ইতিমধ্যেই একটি পরিবেশগত বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। শুধু ১৯৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে, সারা বিশ্বে প্রায় ৮.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উত্পাদিত হয়েছে। এই পরিমাণের অর্ধেক গত ১৫ বছরে উৎপাদিত হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে, এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন প্লাস্টিক পণ্য সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয় উপকূলীয় দেশগুলোর সমুদ্র সৈকতে, যা সেখানকার বাস্তুসংস্থানকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করছে। প্লাস্টিকের ব্যাগের বিকল্প ব্যবহারের বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল এবং এর পরিবর্তনও সময়সাপেক্ষ। এই লেখায় প্লাস্টিকের ব্যাগের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক এবং সেরা বিকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। আশা করা যায়- আমরা প্লাস্টিকের ব্যাগের সঠিক বিকল্পটি বেছে নিতে পারব, যা পরিবেশে অবদান রাখার পাশাপাশি ব্যবহারেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ থাকবে।
১. পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাগজ ব্যাগ
প্লাস্টিকের বিপরীতে, কাগজের ব্যাগ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। কাগজের ব্যাগ প্লাস্টিকের ব্যাগের চেয়ে দ্রুত পঁচে যায়। একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ নষ্ট হতে প্রায় বিশ-ত্রিশ বছর সময় লাগে! কিছু বিজ্ঞানী বলেছেন যে, এটি ২০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তারপরও এটি শুধু অদৃশ্য না হয়ে কেবল ছোট ছোট টুকরো হয়ে যায়, যা পরে মহাসাগর, মাছ এবং বন্যপ্রাণীর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। আরো ভয়াবহ ব্যাপার যে, মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন খাবার এবং পানিতে পাওয়া যায়। কাগজের ব্যাগ পচতে মাত্র এক মাস সময় লাগে। কাগজের ব্যাগগুলো গাছ থেকে তৈরি করা হয়, এবং এটি পরিবেশগতভাবে উপকারী বলে বিবেচিত হয়, কারণ গাছ একটি নবায়নযোগ্য উত্স। প্লাস্টিকের ব্যাগের চেয়ে কাগজের ব্যাগ প্রাণী ও শিশুদের শ্বাসরোধের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। যদিও প্লাস্টিকের ব্যাগের তুলনায় কাগজের ব্যাগ কেনার দামও বেশি, তবুও পরিবেশ ও ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াটা জরুরি।
২. পুনর্ব্যবহৃত ভাঁজযোগ্য শপিং ব্যাগ
পুনর্ব্যবহৃত ভাঁজযোগ্য শপিং ব্যাগ পরিবেশবান্ধব। ভাঁজ করা যায় এমন শপিং ব্যাগের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য হলো সেগুলো বছরের পর বছর ধরে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। এই ব্যাগগুলো ব্যবহার করা খুব সুবিধাজনক, কারণ এগুলো খুব কম জায়গা নেয়। ব্যাগগুলো নিখুঁত, সেরা আর প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প। এগুলো বারবার ব্যবহার করা যায়, ফলে নতুন করে কেনার জন্য অর্থ খরচের দরকার হয় না।
৩. পুনর্ব্যবহারযোগ্য মেশ শপিং ব্যাগ
মেশ বা জাল ব্যাগ প্লাস্টিকের ব্যাগের আরেকটি বিকল্প। এই ব্যাগটি নমনীয়, হালকা, এবং ভারী জিনিসপত্র বহন করার জন্য সুবিধাজনক। এর স্থিতিস্থাপকতা কেনাকাটা অনুসারে প্রসারিত হতে পারে। এটি ফ্যাশনেবল, কার্যকর, টেকসই, এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ।
৪. পুনরায় ব্যবহারযোগ্য তুলোর টোট ব্যাগ
তুলোর শপিং ব্যাগগুলো পুরু এবং শক্ত। একটি একক তুলার শপিং ব্যাগের শক্তি একটি কাগজ বা প্লাস্টিকের ব্যাগের চেয়ে বেশি। এই ব্যাগগুলো হলো সবচেয়ে ফ্যাশনেবল ব্যাগ, যা কেনাকাটার সময় ব্যবহার করা যায়। এগুলোর জনপ্রিয়তা আছে বলে এই ব্যাগগুলো এখন বিভিন্ন ডিজাইনে পাওয়া যায়। যথেষ্ট শক্তিশালী এবং অনেক বছর ধরে স্থায়ী হয়। তুলো টোট ব্যাগ বেশ মজবুত এবং টেকসই হয়।
৫. ক্যানভাস ব্যাগ
ক্যানভাস ব্যাগও তুলা দিয়ে তৈরি। তবে তুলার ব্যাগের তুলনায়, ক্যানভাস ব্যাগগুলো ওজনে হালকা এবং আরও সাশ্রয়ী। এগুলো বিভিন্ন আকারের হতে পারে, এবং অধিক টেকসই হয়। এছাড়াও এই ব্যাগগুলো ধুয়ে বহুবার ব্যবহার করা যায়। প্রচলিত প্লাস্টিকের ব্যাগের তুলনায় ক্যানভাস ব্যাগগুলো সাশ্রয়ী এবং সহজে পচে যায়। তাই এই ব্যাগও প্লাস্টিক ব্যাগের একটি উত্তম বিকল্প। প্রায় মুক্তশিখনের যুগে এই ব্যাগগুলো তৈরির নিয়ম জেনে বাসায় বসেও এগুলো বানিয়ে ফেলা যায়।
৬. ওয়াটার হাইসিন্থ বা কচুরিপানার ব্যাগ
ওয়াটার হাইসিন্থ বা কচুরিপানা একটি জলজ উদ্ভিদ, যাতে থাকে ফাইবার। এটি ব্যাগসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি ফাইবার ব্যাগ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় যা প্লাস্টিকের একটি চমৎকার বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এটি বায়োডিগ্রেডেবল অর্থাৎ, মাটির সাথে মিশে যেতে পারে। একে ব্যবহার করা যেতে পারে বায়োপ্লাস্টিক তৈরিতে, কারণ, এতে উচ্চ পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট থাকে। কিন্তু এই ব্যাগগুলো বেশ ব্যয়বহুল হবে, তবে পরিবেশের কথা বিবেচনা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এতে অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।
৭. সুতা বা উলের তৈরি ক্রোশেট ব্যাগ
এগুলো তৈরি করা সহজ এবং দামও সস্তা। কিছু উল বা বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ বান্ধব সুতা এবং একটি ক্রোশেট সুই দিয়ে এই ক্রোশেট ব্যাগগুলো তৈরি করা হয়। ক্রোশেট হলো একপ্রকার সুই বা হুক, যা ব্যবহার করে সুতা বা উলের সাহায্যে ব্যাগ বা কাপড় তৈরি করা যায়। এই ব্যাগগুলো দেখতে সুন্দর ও পরিবেশের জন্যও উপযোগী। কিন্তু পলিথিন ব্যাগের সহজপ্রাপ্যতা এবং অতিব্যবহারে ক্রোশেট ব্যাগের চাহিদায় টান পড়েছে। পলিথিন ব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে এই উদ্ভাবনী শিল্প আবার নতুন করে জেগে উঠবে।
৮. পাটের ব্যাগ
পাটের ব্যাগ সম্ভবত প্লাস্টিকের ব্যাগের সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বিকল্প। তুলার ব্যাগের মতো পাটও প্রাকৃতিকভাবে নবায়নযোগ্য। এই ব্যাগগুলো পরিবেশবান্ধব এবং সহজেই বায়োডিগ্রেডেবল। এমনকি ব্যাগ তৈরির আগেও, পাট গাছ কার্বন পরিশোধন করে পরিবেশের প্রচুর উপকার করে।
৯. প্লাস্টিকের কাপ ও চামচের বিকল্প
আমরা চায়ের দোকানগুলোতে পাতলা প্লাস্টিকের চায়ের কাপ দেখতে পাই, যা অহরহ ব্যবহার হচ্ছে। এসব কাপ যেমন পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর, তেমনি মানবদেহের জন্যও ক্ষতিকর। চায়ের সাথে অতি ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। তাই এর বিকল্প হিসেবে আমরা এমন কিছু কাপ ব্যবহার করতে পারি যা একই সাথে পরিবেশবান্ধব, টেকসই, আর ব্যবহারকারী চাইলেই সেগুলো ব্যবহারের পর খেয়েও নিতে পারেন। হ্যাঁ, এটা সম্ভব। এছাড়া প্লাস্টিকের চামচের বিকল্প হিসেবেও এরূপ চামচ ব্যবহার করা যায়, যা খাবারের সাথেই খেয়ে ফেলা যায়।
১০. উদ্ভিজ্জ ব্যাগ বা প্যাকেট
বিভিন্ন প্রকার শস্য বা উদ্ভিদের অপ্রয়োজনীয় অংশকে প্রক্রিয়াজাত করে এ ধরনের পরিবেশবান্ধব ব্যাগ বা প্যাকেট তৈরি করা হয়। এটি প্লাস্টিকের একটি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বিশেষত খাদ্য প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার হয়। আখ বা নারকেলের ছোবড়া, ভুট্টা বা গমের অপ্রয়োজনীয় অংশ থেকে এগুলো তৈরি
১১. বাঁশ বা কাঠের তৈরি জিনিস
বাঁশ বা কাঠের তৈরি জিনিসপত্র হতে পারে প্লাস্টিকের বিকল্প। এসব জিনিস পরিবেশের জন্য নিরাপদ, ব্যবহারেও মেলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ও শৌখিনতার পরিচয়।প্লাস্টিকের এই বিকল্প ব্যবহারগুলো আমরা আমাদের বাসা থেকেই শুরু করতে পারি। যে সামগ্রিকতায় বর্তমানে এসে প্লাস্টিক কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার ভবিষ্যৎ গন্তব্য গড়ে দিতে কাজ করতে হবে ছোট পরিবর্তন থেকেই। প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের গ্রহকে বাঁচাতে পারলে বাঁচবে জীবজগৎ। তাই সময় হয়েছে দ্রুত প্লাস্টিক নামক এই বিপজ্জনক জিনিস থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার। তাহলেই আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক পরিবেশ দিতে পারব।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct