প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতির পথে দ্রৌপদী মুর্মু (গ্রুপ সি থেকে জেড প্লাস)
মুদাসসির নিয়াজ
গ্রুপ-সি কর্মচারী থেকে স্কুল শিক্ষক। সেখান থেকে রাজ্যের মন্ত্রী, পরবর্তীতে রাজ্যপাল এবং সবশেষে রাইসিনা হীলের বাসিন্দা হতে চলেছেন ওড়িশার সাঁওতাল আদিবাসী মহিলা দৌপ্রদী মুর্মু। শান্ত ও লাজুক স্বভাবের দৌপ্রদী পড়াশোনায় বরাবরই খুব মেধাবী। রাজনৈতিকভাবে সফল হলেও তাঁর ব্যক্তিজীবন খুবই দুঃখজনক। এক দুর্ঘটনায় স্বামী শ্যামচরণ মুর্মু এবং দুই ছেলেই মারা যান। একমাত্র মেয়ে ইতিশ্রী মুর্মু এখন একটি ব্যাঙ্কে কর্মরত। ৬৪ বছর বয়সি দৌপ্রদীর বাবা বিরাঞ্চি নারায়ণ টুডু এবং দাদু দুইজনেই গ্রাম প্রধান ছিলেন। ওড়িশায় জন্ম নেওয়া দ্রৌপদীর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ওড়িশা সরকারের গ্রুপ-সি কর্মী হিসেবে। পরে অবশ্য স্কুল শিক্ষিকা হন। সব ঠিকঠাক থাকলে তিনি ভারতের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। সি থেকে জেড প্লাস ক্যাটেগরিতে পৌঁছবেন দৌপ্রদী মুর্মু। ১৮ জুলাই নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি একসঙ্গে দুটো রেকর্ড করবেন। প্রথমত তিনিই হবেন ভারতের প্রথম আদিবাসী-উপজাতি রাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয়ত ওড়িশা থেকে এই প্রথম কেউ দেশের সাংবিধানিক প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হবেন। ১৯৫৮ সালের ২০ জুন ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার বাইদাপোসি গ্রামে জন্ম দৌপ্রদী মুর্মুর। যদিও তাঁর বসতবাড়ি ওড়িশার রায়রাংপুর। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত ওড়িশা সরকারের জলসম্পদ ও শক্তি দফতরে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন সেন্টারের সাম্মানিক শিক্ষক ছিলেন। ১৯৯৭ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়ে প্রথম কাউন্সিলর হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তারপর রায়রাংপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান হন।
পরবর্তীতে রায়রংপুর বিধানসভা থেকেই দু’বার বিধায়ক হন। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক-এর নেতৃত্বাধীন বিজেডি-বিজেপি জোট সরকারে পরিবহণ, মৎস্য এবং পশুপালন দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। এরপর ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল (২০১৫-২০২১) হন আদিবাসী নেত্রী দ্রৌপদী মুর্মু। মঙ্গলবার ২১ জুন রাতেই বিজেপি সভাপতি জে.পি নাড্ডা পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে ক্ষমতাসীন শিবিরের তরফে দ্রৌপদী মুর্মুর নাম ঘোষণা করেন। তার আগে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা ও জাতীয় কর্মসমিতির উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। সেখানেই দৌপ্রদীর নামে সিলমোহর পড়ে।উল্লেখ্য, দু-একদিন আগেও কিন্তু দৌপ্রদীর নাম শোনা যায় নি। দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন তামিলনাডুর রাজ্যপাল তামিলি সৌন্দরাজন, কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মাদ খান প্রমুখ। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে আচমকাই তাঁরা ব্যাকফুটে চলে যান। ঠিক এভাবেই ৫ বছর আগে আচমকাই উঠে এসেছিলেন রামনাথ কোবিন্দ।বিরোধীরাও তাদের জোটের প্রাথী হিসেবে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থ ও বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিনহার নাম ঘোষণা করেছে। অবশ্য ১৮ বিরোধী দলের সম্মিলিত জোটের প্রার্থী প্রাক্তন IAS, বাজপেয়ী সরকারের অর্থ ও বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিনহার থেকে সংখ্যার নিরিখে অনেকটাই এগিয়ে আছেন দৌপ্রদী মুর্মু। তবুও পক্ষ-প্রতিপক্ষ সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ায় নিয়ম মাফিক আইএএস সিনহার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে শিক্ষিকা দৌপ্রদীকে। অনেকে বলছেন, ‘রাম-রাজনীতি’র ধ্বজাধারী বিজেপির এটা মহাভারত-স্ট্রোক। এক্ষেত্রে ‘দ্রৌপদী’ নামটাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। গতবারও শুধুমাত্র নামের কারণেই বেছে নেওয়া হয়েছিল রামনাথ কোবিন্দকে। যেমন একইভাবে লোকসভার স্পিকার হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ওম বিড়লাকে। জাতপাতের রাজনীতির সওদাগর বিজেপির কাছে কাম নয়, নামই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে দৌপ্রদীর ক্ষেত্রে নামের থেকেও বেশি কাম করেছে আদিবাদী উপজাতি পরিচয় বা জাতপাতের রাজনীতি। ঠিক যেমনটা হয়েছিল আগেরবার দলিত নেতা হওয়ায় রামনাথকে রাইসিনা হীলে বসিয়েছিলেন মোদি-শাহরা।
তবে কেউ কেউ ভাবছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ যশবন্ত সিনহা যেহেতু আপাদমস্তক আরএসএস ঘরানার লোক, তাই হয়ত বিজেপি আর নতুন করে প্রার্থী দেবে না। সংঘ পরিবারের একনিষ্ঠ সদস্য যশবন্তকে যেহেতু কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল সবাই মেনে নিয়েছে, সুতরাং বিজেপিও তাকেই সর্বসম্মত প্রার্থী বলেই মানতে বাধ্য হবে। কিন্তু না, সেটা আপাতত হল না। কারণ, যশবন্ত প্রথম থেকেই নরেন্দ্র মোদির কট্টর বিরোধিতা করে চলেছেন। তাই তাঁর রক্ত গেরুয়া হলেও, তিনি পুরোদমে সংঘী হলেও, তাঁকে সঙ্গী করলেন না মোদি-শাহ জুটি। শারদ পওয়ার, ফারুক আবদুল্লা এবং গোপালকৃষ্ণ গাঁধী একে একে সবাই নাকচ করে দেওয়ায় অগত্যা জাতীয় রাজনীতির ময়দানে পরিচিত মুখ যশবন্তকেই মাঠে নামানো হয়। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন মমতা ব্যানার্জী। প্রথমত তাঁর পছন্দের এবং তাঁরই দলের একজন সাংসদকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হল বিরোধী জোটের শরিকরা। মমতার কাছে এটা কম বড় প্রাপ্তি নয়। আবার যশবন্তের হিন্দুত্ববাদী মন্তব্য নিয়ে মাঝেমধ্যেই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছিল মমতাকে। তাই পরাজয় নিশ্চিত জেনেও যশবন্তকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করে আপদ বিদায় করল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু মোদির একান্ত অনুগত রামনাথকে বিজেপি কেন দ্বিতীয়বার প্রার্থী করল না -- তা বোধগম্য হল না। আবার উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডুকেই বা কেন রাষ্ট্রপতি পদে প্রোমোশন দেওয়া হল না, সেটাও ধোঁয়াশাচ্ছন্নই রয়ে গেল। দেখা যাক এবার উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি কী চমক দেয়? সেক্ষেত্রে মুক্তার আব্বাস নাকভীর শিকে ছেঁড়ে কিনা সেটাই এখন লক্ষ ডলারের প্রশ্ন। সবশেষে যে কথা না বললেই নয়, সেটা হল ভারতের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি নামমাত্র শাসক। সবকিছুই করে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার বা মন্ত্রিসভা। শুধু নাম কা ওয়াস্তে রাষ্ট্রপতি সই করেন। সেদিক থেকে বলা যায়, আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি কেবলমাত্র রাবারস্ট্যাম্প। তাই এ নিয়ে খুব বেশি মেধা ও সময় অপব্যয় করার প্রয়োজন নেই। তবে রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলে কোনও বিতর্কিত বিলে সই নাও করতে পারেন বা সরকারকে পুনর্বিবেচনা করতে সংশ্লিষ্ট বিল ফেরত পাঠাতে পারেন। তার বেশি কিছু করণীয় নেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct