আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা গ্রীষ্মে বাড়ে
তুহিন সাজ্জাদ সেখ
_____________________
ফ্রান্সের ১৩৩ বছরের বৃদ্ধা ‘লৌহ মানবী ‘ আইফেল টাওয়ার প্রচন্ড গরমে প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় বেড়ে যায়। শুধু তাই নয় ফ্রান্সের প্যারিস শহরের ‘চ্যাম্প ডে মারস্ ‘- এর উপর দন্ডায়মান ৩৩০ মিটার লম্বা এই সুদীর্ঘ টাওয়ারটি প্রচন্ড গরমে সূর্যের বিপরীত দিকে একটু ঝুঁকেও যায়। তবে মজার বিষয় হল যে টাওয়ারটি শীতকালে পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ফরাসি সংস্কৃতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর এই টাওয়ারটি ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতি হিসেবে তৈরি করা হলেও ক্রমশ এটি পৃথিবী শ্রেষ্ঠ একটি গঠন রূপে পরিচিতি লাভ করেছে। ৪৮°৫১’২৯.৬” উত্তর অক্ষাংশে এবং ২°১৭’৪০.২” পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত এই সুদীর্ঘ টাওয়ারটির গঠনকাজ শুরু হয়েছিল ১৮৮৭ সালের ২৮শে জানুয়ারি ও কাজ সম্পন্ন হয়েছিল ঠিক দুবছর পরে ১৫ই মার্চ। প্রথমবার সাধারণ মানুষের দেখার জন্য প্রবেশ অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ওই বছরই ৩১শে মার্চ। আইফেল টাওয়ার নামটি একজন ইঞ্জিনিয়ার ‘গুস্টাভে আইফেল ‘ তাঁর নামানুসারে রেখেছিলেন। দূরদর্শন এবং পর্যবেক্ষণ - এই দুই কাজের জন্য ব্যবহার করা হয় এই সুদীর্ঘ টাওয়ার টিকে। প্রায় ৮১ তলা প্রাসাদের সমান উচ্চতা বিশিষ্ট এই গঠনটি দিনে দিনে পর্যটকদের কাছে এত বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে ১৯৯১ সালে ইউনেস্কো “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট”-এর মর্যাদা দেয়। তবে মজার বিষয় হল এই যে ১২৫ মিটার বাহু বিশিষ্ট বর্গাকার ভূমিতলের এই সুদীর্ঘ গঠনটি প্রচন্ড গরমে কয়েক সেন্টিমিটার উপরের অংশে বেড়ে যায়। কিন্তু কেন ?
--- এর কারণ হলো এই বিশাল টাওয়ারটি যে উপাদান দিয়ে তৈরি সেটা এবং তার তাপীয় প্রসারণ।
গোটা আইফেল টাওয়ার টিকে গুস্টাভে আইফেল নামে ওই ইঞ্জিনিয়ারের কোম্পানি প্রায় ৭৩০০ টন পেটা লোহা দিয়ে তৈরি করেছেন। এই পেটা লোহা তাপমাত্রার তারতম্যের সাথে সংবেদনশীল --- তাই গরমকালে বেড়ে যায় আবার শীতকালে কমে গিয়ে পুনরায় সেই জায়গায় ফিরে আসে। পেটা লোহা মৃদু, নমনীয় ও তন্তুজ হয়ে থাকে। এই লোহার মধ্যে ০.১ শতাংশেরও কম কার্বন এবং ১-২ শতাংশ পরিমাণ ধাতুমল উপস্থিত থাকে। পেটা লোহার গঠন অনেকটাই জালিকাকার অর্থাৎ অণু পরমাণু গুলো একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কেলাসাকার অবস্থায় থাকে। এই ধরনের লোহা আংশিকভাবে ধাতুমল বিজড়িত অর্ধদ্রাব্য বিশুদ্ধ লৌহগোলক থেকে তৈরি করা হয়। ১৭৮৪ সালে ইংল্যান্ডের হেনরি কর্ট “পুডলিং” প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে এই ধরনের লোহা উৎপাদনের উপায় বার করেন, পরবর্তীতে যা বহুল প্রচলিত হয়ে পড়ে। এই পদ্ধতিতে গলিত ঢালাই লোহাকে একটি ফাঁপা বিস্ফোরিত চুল্লির মধ্য দিয়ে পাঠিয়ে উচ্চচাপে উত্তপ্ত করা হয়; ফলে জারক গ্যাসের মাধ্যমে কার্বন নির্গত হয়ে যায়। এর পর কার্বনমুক্ত কঠিনের পরিমাণ বেড়ে যায়,যা আসলে ধাতু ও ধাতুমলের মিশ্রণ। পরবর্তীতে ওই ঘন মিশ্রণটিকে নিষ্পেষক যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে পাঠিয়ে আরও ধাতুমল বের করে দেওয়া হয় এবং একটি মসৃণ চোঙাকৃতি লৌহ পিন্ড পাওয়া যায়। এই পিন্ডটিকে আরও বেশি করে মেজে ঘসে পেটা লোহা তৈরি করা হয়।
এই ভাবে উৎপন্ন পেটা লোহা ঢালাই লোহার চেয়ে অনেক বেশি উৎকৃষ্ট। পেটা লোহার গঠন এই রূপ হওয়ার জন্যই এর তাপীয় প্রসারণ ঘটে।পেটা লোহার অন্তস্থিত একক আণবিক বন্ধন তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে দীর্ঘায়িত হয় এবং তাপমাত্রা কমলে আবার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এই গুণের জন্য তাপমাত্রা বাড়লে কঠিন পেটা লোহার মধ্যস্থিত আণবিক সমন্বয় বল কমে গিয়ে দুটি অণুর মধ্যবর্তী দূরত্বকে বাড়িয়ে দেয়। তাই এই লোহার তাপীয় প্রসারণ ঘটে। ফলস্বরূপ পেটা লোহা দিয়ে তৈরি আইফেল টাওয়ারেরও তাপীয় প্রসারণে সাড়া দেয়। বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা ও অপরিসীম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় এই আইফেল টাওয়ার। স্থানীয় ভাষায় যার ডাকনাম “লা ডেম ডে ফার” । এই টাওয়ারটি কে পেটা লোহা দিয়ে বানানো ইঞ্জিনিয়ারদের কুশলী মস্তিষ্কের প্রমাণ মেলে। কাঠামো তৈরি বিষয়ক ইঞ্জিনিয়ার মরিস কোয়াচলিন ও এমিনে নওগুইয়ার এবং স্থাপত্যবিদ স্টিফেন সওভেস্ট্রে -এর নিবিড় দূরদর্শনের ফসল এই আইফেল টাওয়ার --- যা আজ জলবায়ু পরিবর্তনের সাথেও লড়াই করতে প্রস্তুত। প্রচন্ড তাপমাত্রা বাড়ার ফলে তালমিলিয়ে নিজেকেও বাড়িয়ে অস্তিত্ত্ব রক্ষা করে চলেছে এই সুবিশাল যান্ত্রিক পরিকাঠামো টি। তাই একথা জোর দিয়ে বলা যায় “বিজ্ঞান” শব্দের অর্থ যে বিশেষ জ্ঞান তা যথার্থই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct