রাজমিস্ত্রি
গোলাম মোস্তাফা মুনু
______________
জাহির আলি একজন অভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রি। বয়স ষাটের ঊর্ধ্বে। তিনি কাজ ভালো করলেও তাকে অনেকেই পছন্দ করে না। কারণ, এখন তার কাজের গতি কমে গেছে। বেশি কাজ না পেলেও তিনি তার পেশা পরিবর্তন করতে চান না। তার দুই ছেলে আলাদা আলাদা বাড়ি বানিয়ে আলাদাভাবে ঘর-সংসার করছে। বাবা-মাকে তারা মাসে মাসে কিছু টাকা দিয়ে থাকে। কিন্তু সেই টাকাতে তাদের কুলাই না। কোনো কোনো মাসে ছেলেরা টাকা দিতে যেন ভুলে যায়। বাবা তাদের কাছে কোনো দিনই টাকা চাইতে যান না। তার যেন সম্মানে লাগে। বেশ কয়েকদিন ধরেই জাহির আলী বসে আছেন। কাজ পাননি। কিন্তু তার কাজের খুবই দরকার। হাতে টাকা নেই। সংসার চালাবেন কী করে! জাহিরের স্ত্রী স্বামীকে পরামর্শ দেন, ‘এ মাসে বড় ছেলে আমাদের হাতে টাকা দেয়নি। হয়তো ভুলে গেছে। তুমি না হয় একবার ওর কাছে যাও। গেলে টাকা দেবেই। তোমাকে আর এত ভাবতে হবে না।’ জাহির আলী আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমি যখন কাজ থেকে ফিরতাম তখন মনে করে করে সবার জন্য সব কিনতাম। একটা দিনও বাদ যায়নি যে, তাদের পছন্দের জিনিস আমার কেনা হয়নি। আমি তো কখনো ভুলতাম না খিদিরের আম্মা!’
জাহিরের স্ত্রী আর কোনো কথা না বলে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। জাহির আলী স্ত্রীর দিকে এক নজর চেয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি যদি একদিন কাজ করি তাহলে তিনদিন সংসার চলবে। কাজের কথা পাকা হয়ে আছে। আমি কাল থেকেই কাজে যাবো।’ বলে জাহির আলী আলনা থেকে পাঞ্জাবিখানা নিয়ে ঘাড়ে দিয়ে আসরের নামাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। সেদিন রাত্রে জাহিরের যেন ঘুম আসে না।মনে একরকম আনন্দ অনুভব করছেন। প্রায় বারো দিন পর কালকে কাজে যাবেন। মন দিয়ে কাজ করবেন। সময়ের একটু আগেই গিয়ে কাজে লেগে যাবেন। হাত চালিয়ে কাজ করবেন। অন্যান্য রাজমিস্ত্রির তুলনায় একটু বেশিই কাজ করবেন। তিনি প্রমাণ করে দেবেন যে, বয়স হলেও তিনি কাজ বেশি করতে পারেন। অন্যান্য মিস্ত্রিদের থেকে পিছিয়ে থাকেন না। এমন চিন্তাভাবনা করতে করতে তার ঘুম চলে আসে। সকাল ছ’টা। জাহির আলী কাজের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছেন, এমন সময় তার স্ত্রী বলে উঠেন, ‘না খেয়েই যে বেরিয়ে যাচ্ছ? ছাতু গুলে দিচ্ছি, খেয়ে নাও।’ ‘না, আর দেরি করতে চাই না। ওখানে গিয়েই খাবো। ওরা তো নাস্তা-পানি খেতে দেবেই।’ বলে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
আধ ঘণ্টার মধ্যে কর্মস্থলে পৌঁছে যান জাহির আলী। অন্যান্য রাজমিস্ত্রি সকাল আটটার সময় কাজে লাগে। আর জাহির আলী সাড়ে ছ’টাতেই কাজে লেগে যেতে চান। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি এত সকাল সকাল পৌঁছে গেছেন। যে বাড়িতে তিনি কাজ করবেন সেই বাড়ির মালিক নাকিম শেখ। যুবক ছেলে। বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। জাহিরকে কাজে আসতে দেখে নাকিমের যেন মন খারাপ হয়ে যায়। জাহির নাকিমকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তর দেয় না। মন ভারি করে থাকে। খানিক পরেই নাকিম শেখ জাহিরকে বলে উঠে, ‘ ‘আজকে তোমাকে কাজ করতে হবে না।’ জাহির আলী বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তাহলে কবে থেকে কাজ শুরু করবো?’ ‘আপনার বয়স হয়েছে। আপনি আর কাজে পারবেন না। আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করে অন্য মিস্ত্রির সাথে কথা বলেছি।’ এ বলে নাকিম নীচে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। জাহির এবার হতাশ সুরে বলেন, ‘তুমি যে আমাকে কথা দিয়েছিলে! আমাকে দিয়ে কাজ করাবে বলে ভরসা দিয়ে আমার হাতুড়ি, শাবল এবং গাঁইতি এমন কি সব সরঞ্জাম এনে পুরাতন বাড়ি ভাঙ্গার কাজে ব্যবহার করলে। আর তুমি এখন বলছ...!’ জাহিরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নাকিম বলে, ‘সেগুলো ব্যবহার করার জন্য ভাড়ার টাকা দিয়ে দেবো।’ ‘সেগুলো তো আমি ভাড়াতে দিই না বাবা!’ শান্ত স্বরে বললেন জাহির আলী। নাকিম শেখ জবাবে কিছুই বলতে পারে না। নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। জাহির আলীও কিছুক্ষন নীরব থাকেন। খানিক নীরবতার পর পূর্বের ন্যায় সুরেই জাহির আলী বলতে শুরু করেন, ‘ঠিক আছে বাবা, তোমাকে আর অস্বস্তিতে ফেলবো না। আমার সরঞ্জাম গুলোর যদি তোমার আর দরকার না হয় তাহলে আমাকে দিয়ে দাও।’ নাকিম শেখ জাহিরের মুখের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে ঘরের ভেতর চলে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। হাতে সরঞ্জাম ভর্তি একটি বস্তা। জাহির আলীর সম্মুখে রেখে দেয়। জাহির আলী আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে বস্তা খানা ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct