জীবনানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের চিঠি
সনাতন পাল (শিক্ষক এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক)
________________
বৈশাখ মানেই রবীন্দ্র সাহিত্যের স্মৃতি মনের মাঝে উঁকি মারা, আর মনের মাধুরী মিশিয়ে তাকে উপভোগ করা। কে বলেছে বাঙালি নিঃস্ব! ধন না থাকলেও মান তো আছে, আছে আগের মতোই মনের ব্যাকুলতা, সকলের মাঝেই নিজেকে খুঁজে পাওয়ার স্বাদ। কখনও বোধের অভাব ঘটলেও আছে তো সেই বিলম্বিত বোধদয়। সাঁঝের বেলায় সান্ধ্যকালীন নাম সংকীর্তন আর ভোর বেলার নগর কীর্তন এ যেন বাঙালির মনে আবেগ সৃষ্টিকারী কৃষ্ণ প্রেমে বিভোরতা আর তারই মাঝে মনকে ছুঁয়ে যাওয়া রবীন্দ্র সংগীত। একথা তো শুধু মিছি মিছি বলা নয়, বৈশাখ মানেই রবীন্দ্রনাথ কে আবার নতুন করে খোঁজার চেষ্টা এবং কবিগুরু অনাবিল সৃষ্টির পেছন পেছন ছুটে চলা আর জীবনানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির দুই যুগলবন্দিকে একটু স্পর্শ করা। এ যাবৎ আবিষ্কৃত জীবনানন্দের লেখা এবং তাঁকে লেখা যে ১৩১টি চিঠির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথকে জীবনানন্দের লেখা দুটি এবং জীবনানন্দকে লেখা রবীন্দ্রনাথের দুটি চিঠি রয়েছে। জীবনানন্দ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’-এর একটি কপি পাঠিয়েছিলেন কবিগুরুকে। তিনি সেটি পড়ে একটি ছোট্ট প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। ১৩৩৫ সালের ২২ অগ্রহায়ণ শান্তিনিকেতনে বসে লেখা ওই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘কল্যাণীয়েষু, তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উলটো। ইতি।’
বাংলা ১৩৩৫ সালের ৩ পৌষ কলকাতার ৬৬ হ্যারিসন রোডে বসে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠি জীবনানন্দের মৃত্যুর পর বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। কেননা, চিঠিটি আবিষ্কৃত হলেও এটি রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় নেই। ফলে প্রভাতকুমার দাস (পত্রালাপ জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ১০০) ধারণা করছেন, ভুলে হয়তো চিঠিটি তিনি (জীবনানন্দ) ডাকে দেননি। তা ছাড়া চিঠির পরিপাটি চেহারা দেখলে এই মন্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। চিঠির ভাষা বলছে, এটি রবীন্দ্রনাথের চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার হিসেবে তিনি লিখেছিলেন। শুরুটা এ রকম: ‘আপনার স্নেহাশীষ লাভ করে অন্তর আমার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’ এই চিঠিতে জীবনানন্দ লেখেন, ‘আজকালকার বাংলাদেশের নবীন লেখকদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এই যে, তাদের মাথার ওপরে স্পষ্ট সূর্যালোকের মতো আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীকে তারা পেয়েছে।’ অর্থাৎ পরবর্তীকালে জীবনানন্দ তাঁর প্রবন্ধ ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যে শ্রদ্ধা ও সমীহ প্রকাশ করেছেন, তারুণ্যেই সে ভক্তির ভিত রচিত হয়। তিনি ২৯ বছর বয়সেই রবীন্দ্রনাথকে ‘আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষী’ বলে উল্লেখ করেন। প্রথম চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ভাষা নিয়ে জবরদস্তির যে অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে জীবনানন্দ নিজের একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেন। তিনি লেখেন, ‘কবি কখনো আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করবার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হয়ে ওঠেন, পাতালের অন্ধকারে বিষজর্জর হয়ে কখনো তিনি ঘুরতে থাকেন। বীঠোফেনের কোনো কোনো সিম্ফনি বা সোনাটার ভেতর অশান্তি রয়েছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আজও তা টিকে আছে। চিরকালই থাকবে তাতে সত্যিকার সৃষ্টির প্রেরণা ও মর্যাদা ছিল বলে।’
১৯৩৭ সালে জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশিত হলে জীবনানন্দ এবারও এর একটি কপি রবীন্দ্রনাথকে পাঠান। সঙ্গে একটি চিঠি। বরিশালের সর্বানন্দ ভবন থেকে ১৯৩৭ সালের ৫ মার্চ লেখা ওই চিঠিতে জীবনানন্দ ৯ বছর আগে তাঁকে লেখা একটি চিঠির জন্য রবীন্দ্রনাথকে ধন্যবাদ জানান এবং স্বীকার করেন যে চিঠিটি তাঁর কাছে একটি মূল্যবান সম্পদ। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ আরেকটি চিঠি দেন মাত্র দুই লাইনে। ১৯৩৭ সালের ১২ মার্চ শান্তিনিকেতন থেকে লেখা ওই চিঠিতে কবিগুরু লেখেন—’তোমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এই চিঠির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জীবনানন্দের কবিতার বাঁক বদলের ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট। কেননা, প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’-এ তাঁর যে ভাষা ও ঢং, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে তা থেকে বেরিয়ে একেবারে নিজস্ব ভাষা ও ঢংয়ে আবির্ভূত হন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মাত্র তিনটি শব্দে বলছেন, ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’; অর্থাৎ জীবনানন্দের কবিতার যে চিত্ররূপময়তা, রবীন্দ্রনাথ সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। এই দুজনের সৃষ্টিতেই বাঙালি পেয়েছেন জীবনের স্বাদ বৈশাখের প্রখর রোদ্রে নিজেকে একটু জিরিয়ে নেবার পরশ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct