ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যখন পুরো বিশ্বপরিস্থিতি আমূল পাল্টে দেয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করছে তখন মধ্যপ্রাচ্যে ঘটনাবলির নতুন বিন্যাসের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এই অঞ্চলে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নানা ঘটনা ঘটছে, যাতে মনে হয় বিশ্বের সবচেয়ে সংবেদনশীল এই এলাকায় বড় কোনো বিন্যাস তৈরি হচ্ছে। কূটনৈতিক তৎপরতায় ওয়াশিংটনের কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ‘উত্তেজনা কমানো’ এবং ‘পুনর্বিন্যাস’ নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবে দেখা হয়। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুর্কি বাহিনী কুর্দি বিদ্রোহী বা ইসলামিক স্টেট যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সামান্যই বাস্তব সক্ষমতা প্রদর্শন করে। এরপর তুর্কিরা ড্রোন আবিষ্কার করে। এর ফলে তারা আজ তাদের অটোমান গৌরব অনেকটাই ফিরে পেয়েছে। ২০২০ সালে, লিবিয়ার বিদ্রোহী শক্তিমান খলিফা হাফতার লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি অবরোধ করেছিলেন এবং শহরটির পতন কেবল সময়ের ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। তারপর আঙ্কারা সেখানে উপদেষ্টা এবং ড্রোন-সমৃদ্ধ একটি সেনাবাহিনী মোতায়েন করে, যা লিবিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারকে হাফতারের বাহিনীকে ধ্বংস করতে এবং তাকে রাজনৈতিক আলোচনায় বাধ্য করতে সক্ষম করে তোলে। একই বছর, সিরিয়ার সরকার বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি ইদলিবের বিরুদ্ধে একটি বড় আক্রমণ শুরু করে বাশার আল-আসাদ। ইরান ও রাশিয়ার সহায়তায় পুনর্নির্মিত একটি সাঁজোয়া বাহিনী নিয়োগ করে আসাদ সরকার। এখানেও তুর্কি ড্রোনের একটি ঝাঁক সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে তুর্কি ড্রোনের আরেকটি বহর আজারবাইজানকে নাগরনো-কারাবাখের বিতর্কিত অঞ্চলে তাদের সর্বশেষ রাউন্ডের লড়াইয়ে আর্মেনিয়ান স্থলবাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম করে।
শুধু তুর্কিরাই ড্রোন ব্যবহার করে না। ইরানও ড্রোন ব্যবহার শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তার বিভিন্ন মিত্র এবং প্রক্সিদের মাধ্যমে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান প্রায় দুই ডজন ড্রোন এবং তিনটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আবকাইকের বিশাল সৌদি তেল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে আঘাত করে। ড্রোনগুলো সাইটের চার পাশে বিস্তৃত আকাশ প্রতিরক্ষা এড়াতে সক্ষম হয়। এভাবে তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে সৌদি আরবের প্রায় অর্ধেক তেল উৎপাদন অফলাইনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারপর থেকে ইরানের মিত্র ও প্রক্সিরা বারবার ইরাক এবং সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীকে ড্রোন দিয়ে আঘাত করেছে এবং সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অবিরাম বিমান অভিযান চালিয়েছে। এই ধরনের আক্রমণগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে কার্যকর হয়েছে। কয়েক বছর ধরে কূটনৈতিক ধাক্কাধাক্কির পর কেন সৌদিরা বাগদাদে ইরানিদের সাথে সরাসরি আলোচনায় সম্মত হয়েছিল তা বোঝার জন্য মনে রাখতে হবে যে, এপ্রিল ২০২১ সালে হুথিরা ড্রোন, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সৌদি আরবে ৮৪ বার আক্রমণ করে।
২০ বছর আগে ইরান এবং তুরস্ক তাদের প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করার জন্য খুব দুর্বল ছিল। তারা তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ বেলুচি এবং কুর্দি বিরোধীদের সাথে লড়াই করতে পারেনি। আজ তারা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। তুরস্ক এরই মধ্যে লিবিয়া ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ স্তব্ধ করে দিয়েছে। ইরান সম্ভবত সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ইতিহাসে প্রথম সত্যিকারের কার্যকর জবরদস্তিমূলক বিমান অভিযান চালিয়ে রিয়াদকে একটি দর কষাকষির টেবিলে বসতে বাধ্য করেছে। আমিরাতিরা একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে এবং শুধু স্বল্পমেয়াদে ইরানিদের জন্য অগ্রিম ছাড় দিচ্ছে না; বরং দীর্ঘমেয়াদে তাদের নিজস্ব একটি ড্রোন সেনাবাহিনী তৈরি করতে তারা যা যা করতে পারে তা-ই করছে। সামরিক প্রযুক্তির পরিবর্তনই মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ভারসাম্য পুনর্নির্মাণের একমাত্র কারণ নয়। প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে একটি বহিরাগত মহাশক্তি সর্বদা এই অঞ্চলের আধিপত্য এবং চূড়ান্ত নিরাপত্তা গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করেছে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি অটোমান তুর্কিরা মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ অংশ জয় করে এবং প্রায় ৪০০ বছর ধরে শাসন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পতন হলে ব্রিটিশরা ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং পরবর্তী ৫০ বছর ধরে একই ভূমিকা পালন করে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct