‘মা’ দিবসে এক মায়ের গল্প
আব্দুস সামাদ মন্ডল
________________
নিশুতরাতে হাইওয়েতে ষোলো বা দশ চাকার দানবীয় ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যান এক নারী। পথে ধাবায় পুরুষ ড্রাইভারদের সাথেই খাওয়াদাওয়া, ওঠাবসা। তারপর তাদের অবাক দৃষ্টি, বিদ্রূপ মাড়িয়ে আবার ট্রাক ছোটে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কখনও পথে শুয়ে টায়ার পালটে নেওয়া, কখনও ঘুষখোর পুলিশের সাথে ভাব জমিয়ে রফা করা– এসব অবলীলায় সামলান সেই নারী। অথচ তাঁর সংগ্রাম অশ্রুতই ছিল বিভিন্ন সম্মাননা দোরগোড়ায় এসে পড়ার আগে পর্যন্ত। লিঙ্গভিত্তিক পেশাবিভাজন ফুৎকারে উড়ে যায় এই নারীর জেদ আর সঙ্কল্পের কাছে। সম্পূর্ণ পুরুষ অধ্যুষিত এক জীবিকায় সাংসারিক চাপে পড়েই আসা যোগিতা রঘুবংশীর। প্রথমজীবনে ছিলেন সংসারের চার দেওয়ালে আবদ্ধ গৃহবধূই। তারপর একদিন পথ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন স্বামী। দুই সন্তানকে নিয়ে যোগিতা সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছেন এককালে। তিনি পাশ করা আইনজ্ঞ। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর হঠাৎ উকিলের কোর্ট গায়ে চাপিয়ে পসার জমাতে পারেননি। হাতে সময় ছিল না, তখনই দরকার টাকার। নাহলে ছোট ছেলেমেয়ে দুটির পড়াশুনার ক্ষেত্রে করতে হত ব্যয়সংকোচ। এরপর এক বুটিক শুরু করেন তিনি। মার খান সেখানেও। বুটিক চলে না। অতঃপর রোখ নিয়ে নেমে পড়েন ট্রাক চালানোর পেশায়। তিনি ভারতের প্রথম মহিলা ট্রাকার।
প্রথমে শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই আপত্তি করে। কিন্তু যোগিতা ছিলেন অনড়। স্কুল ফি, খাবার, ওষুধ, পথ্যের টাকা আসছিল হাতে-গরম। যোগিতা বুঝে গেলেন পথই তাঁর ভবিতব্য। ১৬ বছরের ট্রাকার জীবনে প্রায় পাঁচ লাখ কিলোমিটার অতিক্রম করে ফেলেছেন যোগিতা। ‘হয়ত মেকানিকের কাছে গেলাম গাড়ি সারাতে, সে ভাবল স্কুটি সারাতে এসেছি। তারপর আমার বাহন দেখে তার মুখের ভোল বদলে যায়। হয়ত রাতের ধাবায় মেয়েকে দেখে কেউ টিটকিরি মারল, তারপর যখন দেখে সে একটা দশ চাকার ট্রাক চালিয়ে নিয়ে এসেছে, ভেবলে যায় তারাও।’ হাসতে হাসতে বলছিলেন যোগিতা। এসব প্রতিকূলতা তাঁর কাছে বড়জোর হাসির খোরাক এখন। মহিলা ট্রাক-ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিদ্রূপ এককালে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছেন। কিন্তু এখন অবলীলায় বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিতে পারেন লিঙ্গভিত্তিক পেশাবিভাজনের মানসিকতার দিকে। ষোলো বছরে বদলেছে কি কিছু? ‘তেমন কিছুই না। সেদিনও লোকে বিশ্বাস করত না আমি ট্রাক চালাই, আজও বিশ্বাস করে না।’– বললেন যোগিতা।‘মেয়ে এই পেশাতেই আসুক, চাইবেন কি?’ তার উত্তরে অবশ্য ঘাড় নাড়েন তিনি। শুধু সন্তানের জন্য উচ্চাশা নয়, খুব বাস্তবসম্মত কারণ দেখান। যে কম্পানিগুলোতে মাল খালাস করেন তিনি, ১৬ বছর পরেও আজ তারা তাকে টয়লেট ব্যবহার করতে দেয় না। সব পুরুষ শৌচাগার যে! এ পেশায় আজও মেয়েরা এল না তেমন, কেউ মহিলা শৌচাগার তৈরির প্রয়োজনীয়তাও অনুধাবন করল না। তাই মেয়েকে অন্য পেশাই বাছতে বলেন যোগিতা। কিন্তু তাঁর যাপনের মূল মন্ত্র দিয়ে দেন কানে: লোকের কথায় কান না দিয়ে, অকারণ বিরূপ সমালোচনার পরোয়া না করে নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে চলার মন্ত্র। মহিলা শৌচাগারের জন্য লড়াই অবশ্য তিনি চালিয়ে যাবেন আজীবন। হাইওয়েতে নানাবিধ রোগ সংক্রমণ এড়াতে তা জরুরি, তা একজন মহিলার মৌলিক অধিকার বলে তিনি মনে করেন।
২০১৩-তে মহিন্দ্রা ট্রান্সপোর্ট তাঁকে মহিন্দ্রা ট্রান্সপোর্ট এক্সেলেন্স পুরস্কার প্রদান করে। মানুষ চিনতে শুরু করেন এই মহিলা ট্রাকারকে। সঙ্গে পেলেন একটি আস্ত ট্রাক, নিজস্ব বাহন। ২০১৮ সালে ‘সেবাকেন্দ্র, কলকাতা’ তাঁকে দিল ‘সম্বন্ধ’ পুরস্কার। নিজস্ব ট্রাক নিয়ে যোগিতা এখন সারা ভারত চষে বেড়ান অকুতোভয়। ভোপাল থেকে কেরল, জম্মু, জলন্ধর হয়ে ভোপাল ফিরতে পারেন দশদিনে। ট্রাকের পরিযায়ী জীবনেই এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যোগিতা। ঘুরতে চান সারা দেশ। কেবিনই ঘর হয়ে উঠেছে। পথই একমাত্র তীর্থ। একসময় যে পেশায় আসা হয়েছিল প্রয়োজনের তাড়নায়, তা আজ প্যাশন। আরও মহিলা এ পেশায় যোগ দিন তা চান তিনি। ‘নারীরা সব পারে। তাদের আত্মসংযম পুরুষের থেকে বেশি’– এমন মহত্বের ধারণা তাঁর মনে গেঁথে আছে বলেই হয়ত তিনি অতি-নারী হয়ে উঠতে পেরেছেন। এরকম মহত্ব আরোপ হয়ত নারীবাদী ধারণার সাথে মেলে না। কিন্তু নারীর পেশাগত স্বাধীনতার প্রশ্নে অবিচল থেকে যোগিতা নিজের অজ্ঞাতেই নারীমুক্তির পথে বেশ কয়েকটা মাইলফলক পেরিয়ে এসেছেন ট্রাক হাঁকিয়ে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct