রবীন্দ্র ভাবনায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য
মাওলানা মহবুবুর রহমান (সদস্য, বরাকবঙ্গ, অসম)
___________________________________
হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব সমস্যা আমাদের সমাজ জীবনের অন্যতম প্রধান দুরারােগ্য ব্যাধি। ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক কলহের ঘটনা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। বিবেকবান নাগরিকদের সঙ্গে সহৃদয় সাহিত্যিক সমাজ এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন বারবার। রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় হিন্দু-মুসলমান সমস্যার বহুমাত্রিক আলােচনা আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝেছিলেন যে, মুসলমানেরা এদেশের মাটিতে জন্ম গ্রহণ করে এবং এদেশেরই মাটিতে শেষ শয্যা গ্রহণ করে এদেশকে আপনার করে নিয়েছে। তাই হিন্দুদের মত মুসলমানদেরও নিজস্ব স্বাতন্ত্রের অধিকার আছে। তবে তা নিশ্চয় উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্যসম্ভাবনাকে স্বীকার করেই। হিন্দু-মুসলিম বিভেদের কারণে রবীন্দ্রনাথ কতটা দুঃখিত, মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন ছিলেন তার পরিচয় ইংরাজ ও ভারতবাসী প্রবন্ধে পাওয়া যায়। মুসলিমদের অনাত্মীয় বলে দূরে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা কখনো বিশ্বকবির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়নি। ‘ইংরাজের আতঙ্ক’ নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলিম অনৈক্যের জন্য মূলত ইংরেজকেই দায়ী করেছেন। তিনি মনে করেন উভয় সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখা যেন ইংরেজদের অলিখিত নীতি। রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে আলােচনা করেননি, এর সমাধানের কথাও ভেবেছেন। তিনি বলেছেন। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা এই সমস্যাকে দূর করতে হবে। ডানার চেয়ে খাঁচা বড় এই সংস্কারকে বদলে ফেললেই হিন্দু-মুসলমানের মিলন হবে। যে ধর্মমােহ আমাদের মিলতে দেয় না, সেই মােহ থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। ধর্মীয় সংহতি যারা চায় না, অসম্প্রীতির ধূলি-ধূসরতা যাদের কাম্য ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ তারা জানে না। রবীন্দ্রনাথ ভুল পথে হাঁটা ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে সেজন্য তীব্র জেহাদ ঘােষণা করেছেন (‘ধর্মমােহ’ পরিশেষ) সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে ক্ষুব্ধ ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রদত্ত এক ভাষণে (৮ বৈশাখ ১৩১৩) ধর্মমোহ নিয়ে খেদ ব্যক্ত করেছেন। ‘ধর্মের অধিকার’ শীর্ষক আলােচনায় সংশ্লিষ্ট বিষয়টি আরও প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে “ধর্মের দোহাই দিয়ে কোন জাতি যদি মানুষকে পৃথক করতে থাকে, একশ্রেণীর অভিমানকে আর এক শ্রেণীর মাথার উপর চাপিয়ে দেয় এবং মানুষের চরমতম আশা ও পরমতম অধিকারকে সঙ্কুচিত ও শত খণ্ড করে তবে সে জাতিকে হীনতার অপমান থেকে রক্ষা করতে পারে এমন কোন সভাসমিতি কংগ্রেস-কনফারেন্স, এমন কোন রাষ্ট্রনৈতিক ইন্দ্রজাল নেই। এই বিকারেই গ্রীস ও রােমের পতন হয়েছে এবং আমাদের দুর্গতির কারণও রয়েছে তথাকথিত ধর্মাচরণের মধ্যে।” ধর্ম রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল মানুষ হিসেবে মানুষকে দেখা নিয়ে। মানবাত্মার মুক্তি নিয়ে। এই মুক্তিকেই তিনি দীর্ঘজীবনব্যাপী তাঁর সৃজনের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন ধর্মের জন্য যদি মানুষকে মারতে হয়, সে ধর্ম মিথ্যে। ধর্মের দোহাই দিয়ে যদি মানুষ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, এক শ্রেণীর অভিমানকে যদি আরেক শ্রেণীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, মানুষের অধিকারকে যা সঙ্কুচিত করে, তবে তা না মানাই শ্রেয়। সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের নামে যে হিংসা, মানুষে মানুষে বিভাজন ও তা বজায় রাখার যে খেলা চলে রবীন্দ্রনাথের মিলন সাধনার মন তাতে বারবার হোঁচট খায়। এই অশুভ শক্তিকে, মৌলবাদী ধর্মীয় সংঘাতকে চিহ্নিত করে খােলামেলা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, যা থেকে আজও আমরা সতর্ক শিক্ষা নিতে পারি।
ধর্মের বিকৃতি, যা একশ্রেণীর মানুষের স্বার্থরক্ষার ধ্বজা তা-ই যুগে যুগে মানুষের অত্যাচারের হাতিয়ার হয়ে এসেছে। শােষণের ধারা অব্যাহত রাখতে মানব ইতিহাস ঢাকা পড়ে গেছে। অনুন্নত দেশগুলিতে জাতিতে জাতিতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এই ধর্মোন্মাদনাকে আশ্রয় করেই। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্থান, ইরান, তুরস্ক, জাপান, সিঙ্গাপুর, ভারতবর্ষ—সর্বত্র সাম্প্রদায়িকতার জিগির রক্তে ভিজিয়ে দেয় মাটি। ঐতিহ্যময় হাজার বছরের ইতিহাস মুহূর্তে ধসে যায় কামানের গােলায়, শাবল-গাঁইতিতে। রবীন্দ্রনাথ ভারত-ইতিহাসের মূলগত বৈশিষ্ট্য যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য তা যেমন ধরতে পেরেছিলেন, তেমনি বুঝেছিলেন।ভারতীয় ঐতিহ্যের মূল প্রণােদনা ঐক্যমূলক। এই যে ঐক্যবােধ, এই যে এককে প্রত্যক্ষ্য করা ও ঐক্য বিস্তারের চেষ্টা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তা ভারতবর্ষের স্বভাবের মধ্যেই নিহিত। তিনি অভিজ্ঞতার নিরিখে সঙ্গতভাবেই বুঝেছিলেন যে ভারতবর্ষের ইতিহাসের মূল সুর সংঘর্ষ নয়, সামঞ্জস্য। প্রজ্ঞার সঙ্গে সংবেদনশীলতার মিশ্রণে তার সম্প্রীতিভাবনা উদ্ভাসিত, যা বর্তমানের সংকটকালেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের মতে, হিন্দু-মুসলিম বিরুদ্ধাচরণের জন্য ইংরেজের উপর দায়িত্ব না চাপিয়ে সমাজদেহে তার কারণ অন্বেষণ করতে হবে। তার চিন্তায়—“দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্তৃসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানকে আমরা এই সভার অধিনায়ক করিব—তাহাদের নিকট নিজেকে সম্পূর্ণ অধীন, সম্পূর্ণ নত করিয়া রাখিব। তাহাদিগকে সম্মানিত করিয়া দেশকে সম্মানিত করিব।” তিনি লক্ষ্য করেছেন—
হিন্দু মুসলমানের পার্থক্যটাকে আমরা সমাজে কুশ্রীভাবে বেআব্রু করে রেখেছি।সমস্ত বিরােধের মূলে অশিক্ষা, আন্তরিকতার অভাব, শিক্ষাহীনতা, অন্ধ আচারনিষ্ঠা, বিচার ও বুদ্ধিহীনতা। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে, হিন্দু-মুসলমান উভয়েই ‘ভারতভাগ্যের শরিক’। উভয় সম্প্রদায়ের সমকক্ষতা, ঐক্য একমাত্র সম্ভব শিক্ষার প্রসারের দ্বারা শিক্ষার মাধ্যমে বৌদ্ধিক ও আত্মিক উন্নতি এবং মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটে। তাঁর কথায়, আত্মার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার যে কাঁটাগাছ জমেছে, তাকে উৎপাটন করতে হবে এবং নির্ভকিভাবে উভয় সম্প্রদায়ের পরস্পরকে ভাই বলে গ্রহণ করতে হবে। কবি সেই আশা লালন করেছেন।সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থের পরিচয় কবিতায় কবি জানালেন যে, তিনি মানুষের লোক। তবে মানুষের মধ্যে অমানুষও আছে। তারাই সৃষ্টি করে নানা অসাম্য। তারাই ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়গত শ্রেণিভেদ সৃষ্টি করে। এরা শােষক, অত্যাচারী। রবীন্দ্রনাথ এদের ‘মানুষ জন্তু’ বলে সম্বােধন করেছেন। আসলে মানুষের অন্তরে বিরাজিত সার্বজনীন মানবসত্তার প্রতি গভীর বিশ্বাস থেকেই তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র সকল মানুষকে ভালােবেসেছিলেন। এই সার্বজনীন প্রেমই হল ধর্মবােধ। মানুষ আজ এই ধর্মবােধ উপলব্ধি না করে সংকীর্ণ ধর্মীয় মৌলবাদের শিকার হয়ে হারিয়েছে তার মানবিক চেতনা ও মূল্যবােধ। চারদিকে আজ মানুষ-জন্তুর হুংকার, মনুষ্যত্বের পরাভব পীড়নে-শােষণে মানুষ আজ অবহেলার ধুলােয় গড়াগড়ি যায়। মুখে শান্তির বুলি আওড়ালেও ক্ষমতার মদমত্ততার ভয়ংকর প্রকাশ এখানে ওখানে। ধ্বংস, রণ-রক্তপাতে মানবসভ্যতা আজ চরম সংকটাপন্ন। এই বিপন্ন কালীয় মুহূর্তে মানব-সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আজ রবীন্দ্রনাথের মনুষ্যত্বের বাণীকে উপলব্ধি করতে হবে, তাকেই গ্রহণ করতে হবে সভ্যতার সঞ্জীবনী মন্ত্ররূপে। তারই সুরে সুর মিলিয়ে আমরা যেন বলতে পারি—
“সকল জীব সুখিত হােক,
নিঃশত্রু হােক,
সুখী হয়ে কালহরণ করুক। সকল জীব দুঃখ হতে প্রমুক্ত হােক, সকল জীব যথালব্ধ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হােক। তিঁনি পার হয়ে গিয়েছিলেন সেই সংস্কারগত ঘৃণাকে যা নিষ্ঠুর হয়ে মানুষে মানুষে ভেদ ঘটিয়ে সমাজস্থিতির নামে সমাজধর্মের মূলে আঘাত করে।হিন্দু-মুসলমানের মিলনের বাণী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেক কবিতা-গান রচনা করেছেন। ভারতমাতার দুই সন্তানকে মায়ের দুঃখ ঘােচানাের জন্য লড়াই করতে হবে একত্রে। দলাদলি নয়, ভালােবাসাই মূল কথা। প্রেম দিয়ে জয় করতে হবে সকল বিভেদ। যার ধর্ম যাই থাকুক শ্রদ্ধা দিয়ে জয় করতে হবে অপর ধর্মকে। ঐক্যের সুরে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সকলকে আহ্বান জানিয়ে বলতে হবে-
“দাঁড়া দেখি তােরা আত্মপর ভুলি,
হৃদয়ে হৃদয়ে ছুটুক বিজুলি,
.....
আজকের এই কঠোর সংগ্রামের দিনে ভাইয়ের পাশে ভাইকে দাঁড়িয়ে ভারতমাতার সম্মান রক্ষা করার ব্রত গ্রহণ করতে হবে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, সমদেওয়ানী বিধি, হিজাব, হালালা,দাড়ি,টুপি,লাউডস্পিকারে আজান ইত্যাদি ইস্যু।উপরন্তু গণধর্ষণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, গো রক্ষার নামে হামলা, খুন, একক বা দলবদ্ধ অনৈতিক অহেতুক অতর্কিত সন্ত্রাসী হামলা, ধর্ম সংসদে মুসলিম গণহত্যার সন্ত্রাসী আহ্বান ইত্যাদি। এতে জড়িয়ে পড়েছে কিছু কিছু ধর্মীয় সংস্থা। এক্ষেত্রে সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের ভ্রাতৃবৃন্দ তথা নেতাদের প্রতি আন্তরিক বিনীত অনুরােধ তারা রবীন্দ্র রচনাবলি পাঠ করুন। স্বধর্মের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে পরধর্মের প্রতি যদি সম্মান প্রদর্শনে কুণ্ঠা বােধ না করেন তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে অসুবিধা হয় না। হিন্দু-মুসলিম প্রত্যেককে চিন্তা করতে হবে মানুষ বড় না ধর্ম বড়। চণ্ডীদাসের কথা স্মরণ করুন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। এ সত্য উপলব্ধি করতে পারলে পরধর্মসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাবে, ফলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ রােধ করা যাবে। মানবতার সাধক রবীন্দ্রনাথ। স্বধর্মে ও স্বধর্ম পালনে তিনি একনিষ্ঠ ও একাগ্রতার পরিচয় দিয়েছেন। সংস্কারের আবহাওয়ায় লালিত হয়েও তাকে অতিক্রম করে চলে এসেছেন সংস্কৃতির উজ্জ্বল ভূমিতে, অন্ধতা বিসর্জন দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন বাস্তব ও বিজ্ঞানবুদ্ধির আলােক তীর্থে। তার মানুষের ধর্ম তাই মনুষ্যত্বের ধর্ম, যেখানে প্রাণের অবারিত প্রকাশ, যেখানে নেই সংকীর্ণ জাতীয়তা ও সংস্কারের কালাে চেতনা। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ চিরকালই ত্যাগধর্মের উপাসক। সাম্প্রদায়িক ধর্ম মানুষের নিত্য ধর্মকে কিরূপে অবমাননা করে তার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
“হিন্দুর কুয়াে থেকে মুসলমানে জল তুললে তাতে জল অপবিত্র করে। এটা বিষম মুশকিলের কথা। কেননা, পবিত্রতা হল আধ্যাত্মিক রাজ্যের আর কুয়াের জলটা হল বস্তুরাজ্যের। যদি বলা যেত, মুসলমানকে ঘৃণা করলে মন অপবিত্র হয় তা হলে সে কথা বােঝা যেত কেননা, সেটা আধ্যাত্মিক মহলের কথা। এই যে মৈত্রীর আদর্শ, তার মূলে রয়েছে সর্বমানবের ঐক্যের তত্ত্ব। এই ঐক্যতত্ত্বকে রবীন্দ্রনাথ যথার্থ গুরুত্ব দিতেন। তা তার গদ্য ও পদ্যে সুস্পষ্ট হয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে ভারতীয় সংস্কৃতির মূলেই ছিল এই ঐক্যের সাধনা। সন্ত্রাসের সঙ্গে যারা যুক্ত প্রকৃতপক্ষে তারা নির্দিষ্ট কোনও ভূখণ্ডের নাগরিক হতে পারে না। সেই সূত্রে কখনােই তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে পারে না —‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। ঘরে ভালাে হও, সেই ভালােত্ব আপনা থেকেই বাইরে ছড়িয়ে পড়বে। অথাৎ যথার্থ স্বাদেশিকতার পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটবে আন্তর্জাতিকতায়, স্বদেশের প্রতি প্রীতির রূপান্তর ঘটবে বিশ্বপর্যায়ের সম্প্রীতি বােধে। রবীন্দ্রনাথের হৃদয় উৎসারিত এই বাণী সমগ্র পৃথিবী শুনেছিল। সুতরাং, সংকীর্ণ অর্থে দেশপ্রেম নয়, বিস্তীর্ণ অর্থে বিশ্বপ্রেম ও মানবপ্রেম, এই হল রবীন্দ্রসাধনা। অথচ মানব সভ্যতা আজ বিপন্ন। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এমনকি মানবিক আশ্রয়ও আজ বিশুদ্ধ নয়। আজ আমরা যখন একবিংশ শতাব্দীর মানুষ, তখন এই নৃশংসতা মূঢ়তা কাম্য নয়। তবু তা ঘটছে। দেশপ্রেমের ছদ্মবেশে, মানব হিতৈষীর মুখােশে শুধু সর্বনাশই জন্ম নিচ্ছে, যার প্রতিরােধ এখনই দরকার। তাহলে রবীন্দ্র-জীবনের একমাত্র সাধনা ও সাধ হল, মানুষে মানুষে ঐক্য ও মিলন ঘটানাে। শুধু বাঙালি বা ভারতীয় হওয়া নয়, বিশ্ববাসী হওয়া দরকার। তবে যে কোনাে বড় কাজ করতে গেলে আগে ছােটো জায়গায় তার প্রয়ােগ বাঞ্ছনীয়। নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে এবং দেশকে সর্বাগ্রে ভালােবাসতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বারবার তার লেখায় অতীত ভারতবর্ষের মহিমা তুলে ধরেছেন। হতে পারে, একালে সেই আদর্শ অস্তমিত কিন্তু নতুন করে ঐক্যচেতনা তাে গড়ে তােলা যায়। পুরাতন যদি গৌরবের হয়, বর্তমানকে কেন আমরা কলঙ্কিত করব? আজ আমরা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে, এই অস্বাভাবিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে মানবতার উত্তরণের পথ খুঁজব। স্বার্থপরতার আবহকে অতিক্রম করে, ‘সবকিছু নিজের জন্য’—একথা ভুলে আগামীতে একসাথে পা ফেলব। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের ধন্য’—এটাই অঙ্গীকার হওয়া উচিত। বিশ্বকবির ১৬১ তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশ্ব বাঙালির হয়ে জানাই অনন্ত শ্রদ্ধা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct