এবারের কবি প্রণাম
সনাতন পাল (শিক্ষক এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক)
______________________________
২৫শে বৈশাখের সকালে কবি প্রণাম আর রবীন্দ্রজয়ন্তীর নানা অনুষ্ঠানকে বাদ দিয়ে বৈশাখকে ভাবাই যায় না। এক দিকে কালবৈশাখীর ভাবনা আরেক দিকে গুরুদেবের প্রতি সঁপে দেওয়া নিবেদিত প্রাণ। এ যেন আটপৌরে বাঙালির প্রাণের আকুলতায় উদাসী মনে এই দিনে রবীন্দ্র সংগীতের সাথে সাথে প্রজাপতির মত নানা ভাবনার ডানা মেলে ধরা। কোথাও খালি গলায় রবীন্দ্র সংগীত, কোথাও আবার গানের সাথে সাথে তবলায় কাহারবা কিংবা দাদরার চাটি, হারমোনিয়ামের সাথে সাথে পিয়ানো আর তানপুরার ধূলো ঝেড়ে ফেলা। এলোমেলো ছন্দে হলেও কখনও মিছিমিছি নয়, পরম তৃপ্তির স্বাদ উপভোগ করা অনুষ্ঠানের দিন।
একথা জোরের সাথেই বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাঙ্গালীকে ভাবাই যায় না। রবীন্দ্র রচনাবলী এবং বাংলা সাহিত্যের সমুদ্রে অবগাহন করে রবীন্দ্রনাথ তার কাব্যে যে মণি-মুক্তোর তুলে এনেছেন তাকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য একদম অসম্পূর্ণ । সারা বিশ্ববাসীর মনকে নাড়িয়ে দেওয়া রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া, রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্প এবং নাটক কে বাদ দিলে বাংলার সংস্কৃতি একেবারেই অপূর্ণ। একথা বলার জন্য এক মিনিটও ভাবার দরকার আছে বলে মনে হয় না। ২৫ শে বৈশাখ এলেই এসব কত কথা অবচেতন মনে আসে, তার আর কোনো কিনারা থাকে না। ছোটবেলায় পড়া সহজ পাঠ, যৌবনে এসে পড়া ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ, বার্ধক্যে এসে পড়া কবির মৃত্যু বিষয়ক ভাবনা নিয়ে লেখা রচনা আর তাঁর সৃষ্ট ‘ভানু সিংহের পদাবলী’ সবই মনের মাধুরী আর সৃষ্টির অনন্ত অমৃত ভান্ডার। কবিগুরুর দ্বারা সৃষ্ট রবীন্দ্র সংগীত এমন এক অনাবিল সৃষ্টি , যা শোকের সময়ে মনকে শান্ত করে, দুঃখে মানব হৃদয়কে আশ্রয় দেয়, প্রেমের জটিল মুহূর্তে মনকে দিক নির্দেশ করে, বিষাদে- মনকে স্নিগ্ধ করে, গানের কথা, তাল, ছন্দ, লয় কখনও চোখে জল আনে আবার কখনও চিত্তকে আপন হরষে প্রফুল্ল করে তোলে। এখনো তো এমনও মনে হয় যে, গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহে জল তেষ্টা পেলেও বোধহয় রবীন্দ্র সংগীত শুনলে সে তেষ্টা জল ছাড়াই মিটে যায়। কখনও কখনও আবার এটাও মনে হয় যে, তাঁর সৃষ্ট গান যেন জৈষ্ঠ্যের প্রখর রোদ্রের বটবৃক্ষের ছায়া কিংবা বসন্তের ভোরে পুবের হাওয়া, কখনও ঝরা বকুলের ছন্দ, কখনও বা পালতোলা নৌকা, কখনও শ্রাবণের ধারা আবার কখনও বা ঝরণার জলের ছন্দ।
মানুষ থেকে প্রকৃতি, জীবন থেকে মৃত্যু, প্রেম থেকে বিরহ, যৌবন থেকে বার্ধক্য - এমন কোনা ক্ষেত্র নেই, যেখানে রবীন্দ্রসংগীতের ছোঁয়া নেই। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না অথচ অনুভব করা যায়। ২৫ শে বৈশাখ শুধু একজন ব্যক্তি মানুষের জন্মদিন সমগ্র বাঙালির মনে এমন আবেগ সৃষ্টি করে চলে আসছে যুগ যুগ ধরে একথা আমি মানতে রাজি নই। একথা বহুবার মনে হয়েছে যে, ২৫ শে বৈশাখ মানে নতুন একটা সংস্কৃতির জন্মদিন, নতুন এক সাহিত্য অধ্যায়ের জন্মদিন, এক অনন্ত চেতনার জন্মদিন, মনের মাধুর্যের জন্মদিন, প্রেমে নব রাগের জন্মদিন, মলিনতা এবং বিষাদময়-তাকে পথের ধুলো মিশিয়ে দিয়ে সামনের দিকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সমীপে পথ চলা শুরুর জন্মদিন। আমার এই ভাবনার সাথে অনেকেই একমত নাও হতে পারেন। তবুও বলে গেলাম। হঠাৎ করে কোনো এক কাক ভোরে কিংবা নিশুতি রাতে , দুপুর বেলায় অথবা সাঝের বেলায় যাওয়ার ডাক আসে, তখন হয়তো যাবার তাড়া এতোটাই থাকবে যে , চাওয়ার সাথে পাওয়ার হিসেব যেমন মেলানোর সময় থাকবে না, তেমনি আমার পরম শ্রদ্ধেয় প্রাণের মানুষ বিশ্ব বরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের সৃষ্টি সম্পর্কে আমার ক্ষুদ্র মনে যে ধারণার জন্ম হয়েছে, সেটা হয়তো বলার সময় থাকবে না। তাই এই ক্ষণেই কথা গুলো লেখার প্রয়োজনীয়তা। এতো বড় মানুষের সৃষ্টি সম্পর্কে উল্লেখ করলাম, কারো ঠিক বলে মনে না হলেও আমাকে কেউ জেল দিতে পারবেন না, কারণ ‘ভাবনার’ কখনও ‘জেল’ হয় না। গত ২ বছর ধরে কোভিডের কারণে আমরা অনেকেই ২৫ শে বৈশাখকে সকলে সমবেত হয়ে কোনো হল ঘরে বা কোনো মঞ্চে অনুষ্ঠিত করতে পারিনি। এবারে সেই বাধা না থাকাই গত ২ বছরের ঘাটতিটা মিটিয়ে নেবার সুযোগ এসেছে। তাই এবার ২৫ শে বৈশাখে আমরা সবাই প্রাণ খোলা, সবাই বাঁধন ছাড়া- সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচা ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct